এথিক্স, এক্সিডেন্ট আর কিছু প্রশ্ন
- ঋতব্রত
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আজকে সজ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে, আমরা প্রত্যেকে ব্যবহার করি। অজ্ঞানে? কিরকম? গুগল সার্চের পেজ র্যাঙ্ক হোক বা ইন্সটাগ্রামে আপলোড করা রিল কার কার কাছে যাবে, সবার পিছনেই মেশিন লার্নিং এর এলগরিদম ব্যবহার করা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে ভালই, মন্দ কী? আমার কন্টেন্ট যার যার ভালো লাগতে পারে, তার তার কাছে যাচ্ছে, লাইক কমেন্ট ও আসছে। বেশ, কিন্তু মানুষ মারতেও যদি এমন এলগরিদম ব্যবহার হয়?
তাহলে কাটিং এজ এরকম টেকনোলজি ব্যবহারের সঙ্গে যেটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে তা হল এথিক্স। টেকনোলজি থেকে আপাতদৃষ্টিতে দূরে, কিন্তু দূরে কি?
"মানুষ বড়ো সস্তা, কেটে ছড়িয়ে দিলে পারত..."
বছর দুয়েক পিছিয়ে যাওয়া যাক, ২০২৩ সালে মাইক্রোসফট নিজের এআই এবং এথিক্স ডিপার্টমেন্টে লে অফ করে। তুলেই দেয় ডিপার্টমেন্ট টাকে। তারপরে দেখা যায় গাজায় চলমান গণহত্যাকে এক নতুন রূপ দিচ্ছে ইজরায়েল। মানুষ মারায় গুণগত উল্লম্ফনও বলা যেতে পারে। কিরকম? ফেশিয়াল রিকগনিশন, প্রেডিকটিভ পলিসি, সেন্টিমেন্ট এনালিসিস এর মাধ্যমে, প্রতিটা ফোন কল রেকর্ড করে, 'কিলিং অপটিমাইজিশান' চলছে প্যালেস্টাইনে। কাঠগড়ায় যে শুধুমাত্র মাইক্রোসফট উঠবে এমনটা নয়, গুগল কিংবা এমাজন ও কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই ইজরায়েলকে কিলিং টেকনোলজি বিক্রি করতে।
আসলে, বিগ টেক এর কাছে প্যালেস্টাইন একটা ল্যাবরেটরি, যেখানে কত কম সংখ্যক নির্ভুল এয়ারস্ট্রাইকে কত বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যাবে, তার এলগরিদম এরই অপ্টিমাইজেশান চলছে।
তবে আশাও দেখা যায় এই দুর্দিনে, সম্প্রতি BDS (boycott, divestment, sanction) এবং সারা পৃথিবী জুড়ে চলা অসংখ্য মুভমেন্ট এর চাপে মাইক্রোসফট পিছু হঠেছে। তার AI টুল গুলো ইউজ করা থেকে রিস্ট্রেইন করেছে ইজরায়েলের সৈন্যবাহিনীকে।
ফিরে যাই অন্য একটা আলোচনায়, তোমার আমার ডেটায়। আমরা স্মার্ট ফোন ইউজ করি, সোশ্যাল মিডিয়াও। আমাদের রিল স্ক্রলিং হোক বা কার ছবিতে লাইক দিচ্ছি, প্রতিটাই রেকর্ডেড হচ্ছে ডেটা সেন্টারগুলোয়, কাজে লাগছে এআই মডেল গুলো ট্রেইন করতে। তুমি আমি ঠিক কী কী জিনিস পছন্দ করতে পারি, তার সম্ভাব্য লিস্ট তৈরি করছে এলগরিদম। সেই কর্পোরেট আবার ডেটা বেচছে অন্য কাউকে, আমরা দেখতেও পাচ্ছি তেমন বিজ্ঞাপন! তাহলে, একদিকে আমরাই ফেসবুক ইনস্টাগ্রামের কনজিউমার, তেমনই উল্টোপিঠে আমরাই প্রোডিউসার!
এখন প্রশ্ন হল, এইযে আমার ব্যবহারের ডেটা, তা রেকর্ড এবং মডেলকে ট্রেইন করানোর কাজে ব্যবহার করার অনুমতি দিল কে? তুমি আমি তো দিইনি।
মেটা ইন্টারনেটে থাকা সমস্ত বইপত্র, ডকুমেন্ট, পেপার স্ক্র্যাপ করেছে একই মডেল ট্রেইন করবার জন্যে।
বেশ, আজপর্যন্ত জ্ঞান-প্রজ্ঞার যা কিছু অগ্রগতি, তার পিছনে তো রয়েছে গোটা মানবসমাজ! তাহলে, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের যা কিছু পেপার, তা কেন কয়েকশো ডলার দিয়ে কিনতে হবে? যার আবার একটুও পাবেননা পেপারের ডিরেক্ট রাইটাররা? (বরং, তাদেরকেই টাকা দিতে হবে পেপার পাবলিশ করানোর জন্যে)
এলসেভিয়ার, স্প্রিঞ্জার এর থেকে জ্ঞানের মুক্তায়নের জন্যে Aaron Swartz কে জেলবন্দী হতে হয়, বাধ্য হতে হয় সুইসাইড করতে, জুলিয়ান এসাঞ্জ কে জেলবন্দী থাকতে হয় দীর্ঘদিন, সাইহাব, লিবজেন বন্ধ করে দেওয়া হয় বেশিরভাগ দেশে, অথচ সেই একই বিশ্বে গুগল , এমাজন, মাইক্রোসফট লিবজেন, সাইহাব থেকে বই, পেপার ডেটা স্ক্র্যাপ করে মডেল এর এফিসিয়েন্সি বাড়াতে, বিনা অনুমতিতে ডেটা চুরি হয়ে যায় তোমার আমার, বিহেভিয়ার প্রেডিক্ট করে প্রোডাক্ট বেচা হয় আমাদেরকেই। লাভের গুড় খায় বড় কর্পোরেট। মাঝখানে ডেটা সেন্টার, সার্ভারের বিপুল কাঁচামাল তোলে আফ্রিকার কিশোর কিশোরী। মরে প্যালেস্টাইনের শিশু।
জ্ঞানের বিমুক্তায়ন বলি আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, খুব গোদায়, প্রতিটা লড়াই ই যে সংযুক্ত শ্রেণীহীন সমাজের লড়াইয়ের সাথে!
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিশ্বপুঁজি কী ধরনের রাজত্ব চালাচ্ছে তার একটা দৃষ্টান্ত তো দেখা গেল। আসলে AI করছেটা কী? বিশ্বপুঁজি AI কে দিয়ে কী করাতে চায়? কিংবা, AI যা কিছু করছে, কীভাবে করছে?
সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই, প্রশ্ন গুলো করাই হয়তো এই লেখার উদ্দেশ্য।
কয়েকটা জিনিস একটু খতিয়ে দেখা যাক।
চাকরি। ড্রাইভারি। পুঁজির চোখে হীন। মাথা খাটাতে হয়না, ড্রাইভাররা যে বাবু বিবিদের অফিসে নিয়ে যান, তাঁদের মস্তিষ্ক অনেক দামী। এইই তো দাবি পুঁজির?
অথচ, আজকে সেলফ ড্রিভেন গাড়ি যখন চলছে, সেটা হয়ে গেল একটা "ইন্টেলিজেন্ট জব"!
ধন্যবাদ প্রযৌক্তিক অগ্রগতিকে! তা না আসলে হয়তো STEM একাডেমিয়া ড্রাইভারির চাকরিকে কখনও "ইন্টেলিজেন্ট জব" বলে স্বীকৃতিই দিত না। আজকে আনস্কিল্ড, সেমি স্কিল্ড জব সেক্টরগুলোর কাজও ঠিক কতটা ইন্টেলিজেন্সিয়া দাবি করে, (যেগুলোকে প্রতিপদেই দেখেও দেখিনা আমরা) তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তাহলে, গাড়ি চালানো একটা কমপ্লেক্স টাস্ক। মানুষ যখন সেটা করছে, কয়েক সেকেন্ডেই সে প্রচুর সিচুয়েশন এনালাইজ করে, ডিসিশান এ পৌঁছাতে পারছে। তাহলে মেশিন কী করছে?
কোয়ান্টিফিকেশান। গাড়ির সামনে পিছনে ক্যামেরা, সেন্সর যা দেখে অন্য গাড়িকে, তার স্পিড, এক্সিলারেশান, রাস্তার কার্ভেচার, ইনক্লিনেশন, ট্রাফিক সিগন্যাল, রাস্তার মানুষ, অন্যান্য প্রাণী — এই সমস্ত কিছুই প্রব্যাবিলিটি মডেলের ডেটা ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন গাণিতিক যুক্তিতে একে একে দুই হয়, কিংবা মাইনাসে মাইনাসে প্লাস। মানুষের মস্তিষ্ক, সামাজিক কিংবা প্রাকৃতিক ঘটনা কী আদৌ এই ডাইকোটমি তে চলে? তার মধ্যে র্যান্ডমনেস থাকে, এক্সিডেন্ট থাকে, কোয়েন্টিটেটিভ থেকে কোয়ালিটির চেঞ্জ ও থাকে।
কয়েকটা উদাহরণ দিলেই হয়তো স্পষ্ট হয়ে যাবে বিষয়টা।
ধরা যাক সামাজিক কিংবা প্রোডাকটিভ ফোর্সের বিবর্তন,তার অন্তর্দ্বন্দ্ব। কিংবা কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া।
আসলে, এই সেলফ ড্রিভেন গাড়ির তো একটা বাউন্ডারি রয়েছে (কারণ অভিয়াসলি, তার মধ্যে থাকা প্রিসেট প্যারামিটার)। কিন্তু মানুষ?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গল্পটাই শুরু হল মানুষের মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার এর সিগন্যাল আদানপ্রদান কে ইমিটেট করতে। কিন্তু তার মধ্যে তো মানুষের লক্ষ বছরের ইভলিউশানের গল্পও ঢুকে পড়বে! এখন সেটাই তো সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়নি আমাদের কাছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ে গেলেও যেতে পারে। হলেও, তার গোটাটাই যদি নাম্বার আর প্রব্যবিলিটির মডেল দিয়ে দেখি, র্যান্ডমনেস, এক্সিডেন্ট সবই বাদ পড়ে যায়।
তিরিশ চল্লিশের দশক অব্দিও মানুষ-মেশিনের পার্থক্য টানা হত ইন্টেলিজেন্স দিয়ে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেল ইন্টেলিজেন্স তো অন্যান্য প্রাণীদের ও রয়েছে। আলফা গো এসে ইন্টেলিজেন্স, ক্রিয়েটিভিটিরর গল্পও ধূলিসাৎ করে দিল। ডেটা নির্ভর শিক্ষণ আর মানুষের স্বাভাবিক শিক্ষণ এর পার্থক্য ও খানিক দেখতে পাওয়া যায় এখান থেকে।
তাহলে মূল প্রশ্নটা, ইন্টেলিজেন্স-এর নয়, কোয়ান্টিফায়েবেলিটির। হিউম্যান ইভোল্যুশন হোক বা চেতনা। কোয়ান্টিফায়েবল?
আর, এই কোয়ান্টিফায়েবেলিটির চক্করে, প্রতিদিনের খুঁটিনাটি বিষয়ে AI ব্যবহার করতে করতে, আমরা, মানুষরাও, অদূর ভবিষ্যতে মেশিনের মতো করে ভাবব না তো?
Comments
Post a Comment