এ মহা মোহ

-রূপকথা



 এ আই এক ভারি মজার জিনিস। সব জায়গাতেই নাক গলিয়ে বসে আছেন তিনি! ইন্টারনেটে সার্চ করা কিছু, কিংবা তোমার ফিডে কী আসবে তার হিসেব, সবেই তিনি হাজির। এ এক অদ্ভুত প্রাণী। মানুষেরই তৈরি করা প্রযুক্তি, কিন্তু মানুষই মাথা নোয়ায় ক্রমাগত। ‘বড় মজার জিনিস তো!’ বলা আমরাই একদিন চিন্তিত হয়ে উঠি এ আই-পূর্ণ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে। মানুষের বিকল্প কখনো কোনো যন্ত্র হতে পারে না, এ কথা যেমন বলেই থাকি আমরা, তেমনি আমরা এটাও জানি, দেখে এসেছি ইতিহাসে, যে যন্ত্রের কারণেই কাজহারা হয়েছেন বহু মানুষ। একশোজন শ্রমিকের কাজ যখন এক নিমেষে করে দিতে পারছে এক ধাতব যন্ত্র, তখন মানুষকে খাইয়ে পরিয়ে কাজে রাখার দরকারই বা কী। কারণ এই পুঁজিবাদী সমাজে কাজ ও মুনাফা ছাড়া মনুষ্যশক্তি বা মনুষ্যজীবনের মুল্য তো কিছু নেই- !  শ্রমিকদের কাজ যাওয়া ছাড়াও আমরা দেখছি এ আই দিয়ে “জেনারেট” হচ্ছে লেখা, ছবি, আর আসল শিল্পীরা টিটকিরি শুনছেন — আমরা দেখছি কৃষিকাজে কাজ হারাচ্ছেন চাষি, সর্বত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজ কাড়ছে মানুষের, স্মার্ট সিটি গড়ছে তাই মানুষই, আর গর্বের সাথে বলছে যে মানুষের কাজ এবার করবে রোবটই- যেখানে কিনা মানুষ বসে থাকবে বেকার হয়ে। এ আই-এর মোহে পড়ে কোথাও কিছু ভুলও খুঁজে পাচ্ছে না কেউ, আর একটু তাড়াতাড়ি, আর একটু কম খাটনির দৌড়ে পড়ে, মানুষের হাতে তৈরি জিনিসের মূল্য যাচ্ছে ভুলে, মানুষেরও কাজ দরকার সে কথা যাচ্ছে ভুলে। আহা immigrant-রা কাজ কেড়ে নিচ্ছে, যন্ত্র করলেই দোষ?

মনে আছে, প্রথম যখন আলেক্সা, সিরি এসব চিনলাম, অবাক হয়েছিলাম, ভীষণ মজা লেগেছিল। তার অনেক পরে, দু তিন বছর আগে মাত্র, আমরা খোঁজ পেলাম যে এআই-এর সাথে কথা বলা যায়। সিনেমার নানা প্রিয় চরিত্রর সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে, এআই-কে থেরাপিস্ট, বন্ধু, ডাক্তার সবরকমভাবে ব্যবহার করা শুরু হল। তারপরেও ব্যাপারটা বেশ অনেকদিনই বন্ধুমহলে জনপ্রিয়ই থেকে যায়, মেটা এআই থেকে শুরু করে চ্যাটজিপিটি। এই সময়কাল জুড়ে নানা ভাবে আমাদের কাছে খবর এসেছে, কেন এআই খারাপ, কেন প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকারক, ইত্যাদি। মাঝে মধ্যেই উঠে এসেছে এমন অনেক ট্রেন্ড যেগুলো একভাবে যেমন মানুষকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, কিছু মানুষকে চিন্তিতও করেছে, এবং অনেকেই আরো আরো ভাবতে শুরু করেছে খারাপ দিকগুলো। এ এমন এক পৃথিবী, যেখানে সব বয়েসের প্রায় সব মানুষেরই জীবন, এবং তার ফলে এই পুরো সমাজের অনেকটাই, নির্ধারিত হয় ইন্টারনেট জগতের দ্বারা। সুতরাং এই ট্রেন্ডগুলো, এআই-এর মাধ্যমে নানা গোপনীয় তথ্য জোগাড়, শিল্পীবিহীন শিল্প, অর্থনীতির উপর প্রবল ভাবে ছাপ, ইত্যাদি সব ইস্যু ভাবিয়ে তুলছে প্রায় সমস্ত মানুষকে, তারা এআই ব্যবহার করে কি করে না তা নির্বিচারে। ব্যক্তিগত ব্যাপারও তাই আর থাকছে না এর ব্যবহার, হয়ে উঠছে এমন একটি জিনিস যার ব্যবহার ছাপ ফেলছে প্রত্যেক জীবনে। ফলে আমাদের ঠিকঠাক ভাবে বোঝা প্রয়োজন যে এর জন্যে কী ক্ষতি হচ্ছে এই সমাজের, এবং এর বিরোধিতা কেন করছেন এত মানুষ।

প্রথমত যদি আমরা আলোচনা করি প্রকৃতির ক্ষতির ব্যাপারে। এআই চালানোর জন্য যে মেশিনগুলো ব্যবহৃত হয় তা ঠাণ্ডা রাখার জন্য যে পরিমাণ জল ব্যবহার হয়, তা সেই এলাকার মানুষদের জলকষ্ট বাড়িয়ে তুলেছে। কার্বন এমিশনের কারণে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং তার সাথে যুক্ত সমস্ত কিছুর পিছনেই এআই-এর অবদান রয়েছে, একটু বেশীই মাত্রায়। একটা অতি সাধারণ প্রম্পটই শুষে নিচ্ছে এক বিশাল পরিমাণ জল, এবং অন্য নানা সমস্ত প্রযুক্তিগত ‘এগিয়ে যাওয়া’র মতই, সামান্য মজা বা একটু সুবিধার জন্য আমরা তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিচ্ছি আমাদের বাসস্থান, আমাদের পরিবেশের ভাল থাকা।

আগে সব ভাল ছিল, এবং এখন সব খারাপ, এই আলোচনা অত্যন্ত যুক্তিহীন। আমরা বলে থাকি, আগে আঙ্গুলের একটা ছোঁয়ায় আমরা পেতাম না কোনো শব্দের মানে, আমাদের খুঁজতে হত বইতে, এবং সেটাই ছিল ভালো। সে কথা সত্যি হলেও, এটাও মানতে হবে, সবার পক্ষে সম্ভব ছিল না নিত্য নতুন বইয়ের সাহায্য নেওয়া, না সবার পক্ষে সম্ভব ছিল সেই বইগুলোর বিষয়ে জানা। অনলাইন জগতকে ঠিক যতটা দরকার এইগুলো জানার জন্য, ততটা ব্যবহার করলে অনেক বিপদ থেকেই মুক্তি পাওয়া যেত। কিন্তু যেই মুহূর্তে মানুষ মেশিনকে করে তুলছে মস্তিষ্কের বিকল্প, সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটাই। ব্যকরণ ঠিক করতে, বানান ঠিক করতে গুগলের সাহায্যও না নিয়ে, এআইকে সব ঠিক করে দেওয়ার আদেশ দিলেই হচ্ছে হুকুম তামিল। ফলে কোনোরকম লেখার অভ্যেস ঠিকঠাকভাবে তৈরি হচ্ছে না। তৈরি হচ্ছে না কল্পনা শক্তি, চিন্তা ভাবনার ইচ্ছেও। যত কম খাটুনি তত ভালো, এই মানসিকতা জন্ম দিচ্ছে শিক্ষার প্রতি অনীহা, রাগ, ইত্যাদি। সৃষ্টির আনন্দ ভুলতে বসেছি আমরা, এরকম মারাত্মক কথা বলব না, কারণ আমরা এখনো মানুষ। শুধু খেয়াল রাখতে হবে একটু, আমাদের হাত থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে যেন না নিতে পারে কেউ।

এআই যতই মোহের মত লাগুক না কেন, যতই ট্রেন্ডে থাকুক না কেন, আর যতই কাজ কমিয়ে দিক না কেন, মানুষ হিসেবে, এবং পৃথিবীর এই পরিস্থিতিতে এসে একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে, এআই-এর ব্যবহার বন্ধ করা আমাদের প্রয়োজন। যতই শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাক না কেন, এবং যতই সাহায্য করুক না কেন, অত্যন্ত আমরা নিজেরা এমন কিছু করি না এআইকে দিয়ে, যা কিছুতেই ছাড়া যাবে না। ভুলভাল ডিটেইলের অদ্ভুত দেখতে ছবির চেয়ে আমাদের হাতে আঁকা সর্বক্ষেত্রে ভাল। আমাদের নিজেদের হাতে লেখা বা টাইপ করা লেখা শতগুণে ভাল। এমনকি একটা প্রচণ্ড সময় নষ্ট কাজও আমাদের নিজের হাতে করাই ভাল — কারণ, আমার অন্তত মনে হয়, একটা এরকম অদরকারি কাজের জন্য প্রকৃতির ওই অত্ত পরিমাণ ক্ষতি আমাদের কারোরই ভাল লাগবে না ভাবতে, এবং আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই ভাল না তা। প্রকৃতির ক্ষতি যে আমাদেরও ক্ষতি তা বড় বড় ব্যবসায়ীরা না বুঝুক, আমরা সাধারণ মানুষরা না বুঝলে কিন্তু বিশাল ক্ষতি!

Comments