প্রতিবাদী ক্যানভাসে রোদ্দুর রায় : ভাঙাচোরা ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ

- অরুণাভ মন্ডল


অনির্বাণ রায়। সহজ সরল, সাদাসিধে নাম। পদবিটা নির্ঝঞ্ঝাট। ওটা অপরিবর্তিত রেখে যদি নামটা পাল্টে ‘রোদ্দুর’ করে দিই, ব্যাস!! বাঙালি মধ্যবিত্তের পেট গুড়গুড়, গা রিনরিন করবে। বুদ্ধিজীবীরা নাক সিঁটকাবে, মাঝে মাঝে নামটা নিয়ে ব্যুরোক্রেসি করবে। তাদের পরিচিত উপরমহলে স্বীকৃতি পাবে না নামটা, দরকারও নেই কোনরকম। আর সাবআল্টার্নদের চিন্তা–চেতনা, ভাব–আলোচনা, মতামত, স্বাদ-বেস্বাদ, নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা নেই খুব একটা। এই ‘নিচুতলার’ মানুষদের জীবনের প্রায় সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত। সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানের অধিপতি গণ, যারা সামাজিকতার নিয়মাবলী রচনা করেন, তারাই ঠিক করে দেন ‘নিম্ন’ শ্রেণীর জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ। প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ত্রাণ কী কী পাবেন, শাসকশ্রেণী বলে দেবে। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, সাহিত্য কী কী পড়বেন তাও উপরমহলের মন-মর্জিমাফিক চলবে। বিনোদন, ভক্তি, ধর্ম, মতামত, বিচারধারা, সবটাই কড়া হাতে নিয়ন্ত্রিত এবং দমন করা হবে। এক অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত সামাজিক গঠনপ্রণালীর অংশ আমরা, যার নিজস্ব সংবিধান আছে এবং সেটি মেনে চলা প্রতিটি সামাজিক জীবের ভবিতব্য। সাধারণ মানুষের শিল্পসংস্কৃতি, সৃজনশীলতাকে নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে পিটে নিয়ে, গতানুগতিকতার মোড়কে আটকে রাখা হয়। শিল্প ও সংস্কৃতিকে শুধুমাত্র বিনোদনের রূপে দাবিয়ে রাখার অশালীন চক্রান্তে মেতে থাকে সমাজের শাসন প্রণালী। উচ্চমার্গের চিন্তাধারার কতিপয় মানুষজন, যাদের উপর সমাজ সংস্কারের দায় বর্তায়, তারা বেশিরভাগ উচ্চবিত্ত শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায়, দয়াদাক্ষিণ্য নিয়ে বেঁচে থাকেন। কাজেই, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তাদের ধাতে নেই। উচ্চমার্গ এবং উচ্চবিত্ত, দুটির বৈশিষ্ট অনুরূপ হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মধ্য ও নিম্নবিত্তের কাছে পড়ে থাকে শুধু বিনোদন, মন ভোলানোর কারবার। খাবারের জন্য কান্না করা বাচ্চার মুখে ললিপপ গুঁজে দেওয়া হয়, অভিভাবক চুপ করে থাকে, কিছুটা পরিত্রাণ, কিছুটা অসহায়ত্ব। ওই উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের দিকে চেয়ে থাকে সমতলের প্রজা। প্রাসাদের বিত্ত-বৈভব-ঐশ্বর্যের অন্তরালে বাস করে সারস্বত সমাজ। প্রজাদের দৃষ্টি চাকচিক্যের বেড়া ডিঙ্গাতে পারে না। টিলা থেকে দেব নিঃসৃত বাণীর ন্যায় বিবৃতি ভেসে আসে, শিল্প কিরকম হওয়া উচিত এবং কিরকম না হওয়া উচিত। মেনে নেওয়াটা নিয়তি আর প্রশ্ন করাটা দ্রোহ। বামন হয়ে চাঁদের নাগাল পাওয়ার প্রচেষ্টা। অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে দুর্বোধ্যতা, অযথা কাঠিন্য এবং দুর্গমতার জুজু দেখিয়ে জনসাধারণের থেকে শিল্প, সংস্কৃতিকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়। ছিনিয়ে নেওয়া হয় সবচেয়ে প্রভাবশালী, সুদূরপ্রসারী এবং গণতান্ত্রিক অস্ত্র। হাতের কাছে পাওয়া যায় নিম্নমানের বিনোদন, শিল্পের নামে মিডিওক্রিটি এবং পূর্বনির্ধারিত সাংস্কৃতিক দলিল। এসবই হচ্ছে ভোঁতা অস্ত্র, যা কোনদিনই প্রতিষ্ঠানের ভিত নাড়াতে পারবেনা। এক সুচারু সিমুলেশন দ্বারা জনগণকে সম্মোহিত করে রাখার চক্রান্ত চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

রোদ্দুর রায়ের প্রতিবাদ এই বিকৃত সিস্টেমের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানিকতার ঐতিহ্যমন্ডিত ভাষার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে সে। তাঁর মতে জনমানসের মুখের ভাষা হয়ে উঠেছে পুঁজির দাস। কঠোর নিয়মাবলী এবং শৃঙ্খলার বজ্র আঁটুনি ভাষার পরিসরে এক অচলায়তন সৃষ্টি করেছে। ভাষাকে তার পূর্ণ সম্ভাবনার প্রত্যাশা পূরণ করতে দেওয়া হয়নি। শত শত বছরের কুসংস্কার, আনুষ্ঠানিকতা ও রীতিনীতির বাহুল্য ভারে ভাষার কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। সবচেয়ে তীক্ষ্ণ অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে গেছে।

চলন্ত ট্রেনের সামনে লাল পতাকা নিয়ে দাঁড়াবার কাজটি করেছেন রোদ্দুর রায়। প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিপরীতে তাঁর ভাষার দর্শনের অবস্থান। অশ্লীলতার চিরাচরিত সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করেন, দেখিয়ে দেন যে অশ্লীল আসলে ভাষা নয়, ভাবনা। তিনি প্রশ্ন করেন ভাষাকে নৈর্ব্যক্তিক মনে করার ধারণাকে। তাঁর কথায় ভাষার ব্যবহার আদতে বিষয়গত, যা ব্যক্তির ব্যক্তিগত উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল।

একটি মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মতাদর্শ তার সময়, সমাজ, পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবে গঠিত হয়। তাই একজন ব্যক্তির ঔদ্ধত্য, অশালীনতা মোটেও ব্যক্তিগত বিকৃতি নয়, সেটা সামাজিক ব্যাধি।

অক্ষর চেনার জন্য ছবির ব্যবহার, শব্দের দ্বারা প্রবাহিত ভাবনা, সবটাই সমষ্টিগত একটা এবং গোষ্ঠীগত পরিচয়ের বৈশিষ্ট। ভাষার তথাকথিত অপব্যবহার এবং অসামাজিক প্রয়োগ, সেই জাতির চারিত্রিক গুণাবলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলো অস্বীকার করার অর্থ আত্মপরিচয়ের সাথে শঠতা।

রোদ্দুর রায় নিজের দর্শন, অতিশয়োক্তি, রোদ্দুরচিত অপ ভাষার দ্বারা সমাজের এই পচনশীল গতি সর্ব সম্মুখে নিয়ে এসেছেন। রোদ্দুর রায় জনমানসের এই অব্যর্থ অস্ত্র (ভাষা) তাদের হাতে আরও প্রবল রূপে তুলে দিতে চেয়েছেন। ভাষাকে কৃত্রিম গন্ডির ভেতরে আবদ্ধ করে, ডানা কেটে খাঁচায় বন্দী করে মানুষজনকে বোবা, কালা, অজ্ঞ বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। পুঁজিপতিদের নিজ স্বার্থ কায়েমের জন্য শিল্প সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে রাখার বিরাট আয়োজন, ভাষা-সাহিত্যকে সাধারণের নাগালের বাইরে উন্মীলিত করেছেন রোদ্দুর। জনগণের আসল শক্তির সাথে সবাইকে অবগত করা তার লক্ষ্য। তার পদ্ধতির চরমপন্থা, একপ্রকার প্রহসন। সাবেকি দর্শনের ঐতিহাসিকতার ভারে নুয়ে পড়া সমাজ জীবনে, প্রাণশক্তি সঞ্চারের মরিয়া চেষ্টা। রোদ্দুরের লেখা এক কবিতার শেষ দুটি লাইন দিয়ে শেষ করবো – 

‘এই বাল সময়ের গাঁড়ে দাও গুঁজি কঠিন ছিলিম প্রান্ত,

হাড় কঙ্কালময় কবরে পচনে আজি মৃত বিপ্লব হোক জ্যান্ত।।’


Comments