থার্ড থিয়েটার ও বাদল সরকার
- স্রোতস্বিনী সিংহরায়
সাংস্কৃতিক জগতে নাটক এক অতি পরিচিত গণমাধ্যম। শুধু মনোরঞ্জন নয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাট্যকার তাঁদের লেখা নাটকের মধ্যে দিয়ে দর্শকদের কাছে তুলে ধরেছেন সমকালীন সমাজের বিভিন্ন বিষয়। কখনও অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছেন, কখনও দিনবদলের ডাক দিয়েছেন। সেই সব বরেণ্য নাট্যকারদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন বাদল সরকার।
১৯২৫ সালের ১৫ই জুলাই ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন বাদল সরকার। তাঁর আসল নাম ছিল সুধীন্দ্রনাথ সরকার। বৃষ্টির দিনে জন্মেছিলেন বলে তাঁর কাকা তাঁর ডাকনাম রাখেন বাদল। প্রথম জীবনে সুধীন্দ্র নাম নিয়েই তিনি নাটক লিখতেন ও মঞ্চস্থ করতেন। পরবর্তীকালে তিনি ডাকনামেই খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৫০ সালের গোড়ার দিকেই বাদল সরকারের নাট্য জীবন শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম নাটক “সলিউশন এক্স”। পেশাদারিভাবে নাটকের জগতে তিনি আসেন ১৯৬৭ সালে । “শতাব্দী” নামে নিজের একটি নাট্যদল খোলেন তিনি। “শতাব্দী”র প্রযোজিত প্রথম নাটক “এবং ইন্দ্রজিৎ” । “এবং ইন্দ্রজিৎ” নাটকটি কল্পনাধর্মী একটি নাটক যা বাস্তবের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মধ্যবিত্ত জীবনের ওঠাপড়া, অস্থিরতা ও অস্তিত্বের লড়াই ও অপারগতা তাঁর এই নাটকের বিষয়বস্তু ছিল। গুণীজনেরা এই নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই নাটকে তিনি অ্যাবসার্ড আঙ্গিক ব্যাবহার করে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। পরবরতিকালে এই অ্যাবসার্ড আঙ্গিকেই তিনি প্রায় সমস্ত নাটক লেখেন।
পরবর্তীকালে বাদল সরকার উদ্ভাবন করেন এক নতুন আঙ্গিকের নাটকের, যার নাম থার্ড থিয়েটার। এই আঙ্গিকে দর্শক ও অভিনেতাদের মধ্যেকার দুরত্ব ঘুচে যায়। এই ধরণের নাটকে আলাদা করে মঞ্চের কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকে না । নাটকের অঙ্গনেই দর্শকদের বসার জায়গা করা থাকে । নাটকের ঘটনাসমূহ তাদের ঘিরেই এগিয়ে চলে। এই নাটক, পথে প্রান্তরে যেকোনো জায়গায় প্রদর্শিত হতে পারে। পথচলতি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়ে তাদেরকে নাটকের অংশ এবং দর্শক বানিয়ে তোলার প্রচেষ্টা করেন বাদল সরকার। এই ধরণের নাটক দর্শক মনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে এবং নাটকের বিষয়বস্তুকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যায়।
বহু বিখ্যাত নাটকের রচয়িতা বাদল সরকারের কিছু উল্লেখযোগ্য নাটকের নাম -এবং ইন্দ্রজিৎ, সারা রাত্তির, বাকিটা ইতিহাস, শেষ নেই, মিছিল, সুটকেস, পাগলা ঘোড়া, ভুল রাস্তা ইত্যাদি। সারাজীবনে পঞ্চাশটির ও বেশি নাটক লিখেছেন বাদল সরকার। যার প্রত্যেকটি নিজস্বতায়, বক্তব্যে, প্রকাশে, মাধুর্যে আলাদা। “সারা রাত্তির” একটি অ্যাবসার্ডধর্মী নাটক। এটি সামাজিক অস্থিরতা, মানবচরিত্রে বিভিন্নতা ও মনের দ্বৈত সত্ত্বার ছবি তুলে ধরে। “মিছিল” নাটকে দেখা যায় নিপীড়িত, শোষিত মানুষের প্রতি সমাজ ও সরকারের অবহেলা। রাজনৈতিক আন্দোলনের সারবত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। সরকারের উদাসীনতা যেমন দেখানো হয়, তার সমালোচনা করা হয়, আবার তার থেকে উদ্ধারের খোঁজও দেওয়া হয় এই নাটকে। “বাকিটা ইতিহাস” নাটকটি খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখানে মানুষের জীবনে অর্থ ও সম্পর্কের জটিলতা ও সামাজিক অবক্ষয় তুলে ধরা হয়েছে। “ভুল রাস্তা” বাদল সরকারের আর একটি অনবদ্য সৃষ্টি। নাটকের রাজপুত্র, কোটাল পুত্র থেকে থেকে শুরু করে সব চরিত্রই যেন আজকের সমাজের প্রতিচ্ছবি। গরীব প্রজারাই যে রাজাকে রাজা বানায়, আর হাতে ক্ষমতা পেলেই যে মানুষ শাসক থেকে শোষকে পরিণত হয়, তা এই নাটকে খুব স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। সবশেষে মানুষের পাশে মানুষকে দাঁড়াবার আহবান জানায় এই নাটক। প্রতিটা নাটকের মধ্যে দিয়েই নাট্যকার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজ বদলের ডাক দিয়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন ভেদাভেদহীন এক নির্লোভ সমাজের।
বরাবর সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন বাদল সরকার। তাই তাঁর প্রতিটি লেখায় বোঝা যায় সাম্যবাদের প্রতি নির্ভরশীলতা। কলমকে হাতিয়ার করে নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের পাশে তিনি বরাবর থেকেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে জাগিয়েছেন সাম্যের চিন্তা। অতি দক্ষতার সাথে উপহার দিয়েছেন তাঁর নিজের হাতে তৈরি বহু নাট্য প্রতিভাকে। ব্যাক্তি জীবনে তিনি মৃদুভাষী ও নিরহংকারী হলেও তাঁর কলমে ছিল অস্ত্রের মত ধার।
শেষজীবনে তিনি কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি। নাটক লেখা ও নির্দেশনা — দুইই চালিয়ে গেছেন।
২০১১ সালের ১৩ইমে কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একজন নাট্য বিপ্লবী ও পথিকৃৎ হিসাবে তাঁর নাম ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাহ্; কম কথায় ভালো লেখা!
ReplyDelete