দ্বন্দ, আবহমানতা, ও মহীনের টগবগ

- বেদব্রত


ঘুপচি-ঘোড়া-চ্যাংড়া:টগবগ….টগবগ

 

এইটা পিনিক। নিখাদ পিনিক। ফ্যাণ্ডম ও ফ্যান্টাসি যেখানে গেড়ে বসে সেখানে যাহাই জন্মে তাহাই পিনিক। এবার পিনিকের একটাই সমস্যা। পিনিক তো অনেকাংশে ব্যক্তিগত, তবে ব্যক্তিগত যা কিছু তা কালেকটিভকে ধারণ করতে পারবে না তেমনটা নয়। ব্যক্তি থেকে সমষ্টি, সমষ্টি থেকে তার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া- এই যে চলন, এই চলনই তো প্রগতিশীলতার অন্যতম কথা। সব আমার, সব তোমার, যৌথ খামার যৌথ খামার। ব্যক্তিগত ফুটোয় আঙ্গুল ঢুকিয়ে কখন যে সিস্টেমিক বর্বর এর চামড়া খামচে ধরেছে তা এখন খানিক ধরতে পারি।

আমি এখানে শুধু বা শুদ্ধ মহীন নিয়ে শুধু ভাটাবো না। বরং মহীন ও তার সংস্রব, এরা যা যা কাজবাজ করেছে তাই খানিক মিলিয়ে মিশিয়ে ভাটাবো। খুব চটপট যদি একটু ক্রোনোলজিটা বলা যায়, প্রাথমিক ভাবে মহীনের ঘোড়া সাতজন লোক, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ তিনটে অ্যালবাম সেখানে আটটা গান। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর গ্যাপ। গানগুলো কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। গড়ে ওঠে গড়ের মাঠ, ক্রসউইন্ডজ, লক্ষ্মীছাড়া এবং মহীন ও তার বন্ধুরা। এদেরকেই সংস্রব বলে উল্লেখ করেছি। তখন আবার চারটি অ্যালবাম (১৯৯৫ ও ১৯৯৯ এর মধ্যবর্তী) তখন মহীনরা সম্পাদনার ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই যে ব্যাপারটা ঘটলো, বেশ কয়েকটা অ্যালবাম, বেশ কয়েকটা গান এবং আরো কিছু ইন্ডিভিজুয়াল ও রেকর্ড না হওয়া আর কিছু গান- মূলত এই নিয়েই ভাট বকব। তৎকাল-সমকাল, গানগুলোর ইতিহাস নয় বরং গানগুলো যেভাবে আমার ও কালের হার্ডডিস্কে প্রসেসড হয়েছে সেই নিয়ে বলব।

 গান এই বিষয়বস্তুটাকে আর শুধু শোনার গন্ডির মধ্যে আটকে না রেখে, ওটাকে যে লোকদের দেখাতেও হবে এই কথাগুলো বাংলায় তীব্র ভাবে বলেন সুমন, কবীর সুমন। অত জোরের সঙ্গে উক্ত করতে না পারলেও মনে হয় এই প্রক্রিয়া সুমনের অনেক আগেই বাঙলায় শুরু হয়ে গেছিল। হয়েছিল মহীনের হাত ধরেই। এই যে আমার এই উটকো উক্তি, তা থেকে দুটো প্রশ্ন উঠতে পারে, ১. গানের সঙ্গে ভিজুয়ালাইজেসনের কী সম্পর্ক? আর ২. মহীনেরা কী করে এই সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝে কাজ করেছে (অ্যালবাম খুলে দেখাও!)? দুটো বস্তু বিক্রিয়া করলো। করার ফলে এক বা একাধিক নতুন বস্তুর জন্ম হল। এর ফলে সেই বিক্রিয়ক বস্তুগুলোর নতুন কিছু ধর্মের মুখোমুখি আমরা হই। অর্থাৎ বস্তুটিকে আরো খানিক ভালো করে চেনা হয়ে ওঠে। ওই যে শুদ্ধতা (ভাববাদী), তাকে খানখান করে ভেঙেই উঠে আসছে মিশ্রণ, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক চিন্তাধারার ধারক হয়ে। বর্তমান দিনে যদিও পুরোটাই পণ্যের রূপ নিয়েছে- সে আলাদা আলোচনা। তৎকালীন এই যে মিক্স মিডিয়া, সে যেকোনো শিল্পের ফর্মেই, আঁকা থেকে সিনেমা থেকে গান, আরও স্পষ্ট করে দেখালো যে তোমার সমাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান তোমাকে একটি সেকশন অফ আর্টস কনসিউম করাচ্ছে- অর্থাৎ তোমার শোনা গানটা উড়ু উড়ু নয়, বরং তোমার কনশাস ও সাবকনশাস এর মাঝের উড়ালপুল- যেই কনসাস ও সাবকনশাস তোমার নিত্য ক্রিটিকাল অবজার্ভেশন এর মাধ্যমে সংগঠিত। তো খানিক খানিক বোঝা গেলো যে গানে ভিজুয়্যাল ইমেজারি কেন প্রয়োজনীয় বলে অনুভব করেছিলেন। লেখার পরবর্তীতে সে সময়কার ঐতিহাসিক অবস্থান উল্লেখ করলে তা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। 

এবার আসা যাক দু নম্বর প্রশ্নে: অ্যালবাম খুলে দেখান! খানিক নিচে প্রথম তিনটে অ্যালবামের কভারের ছবি ও তাদের ইউটিউব লিংক দেওয়া রইলো। আমি চাই তোমরা আমার এই লেখাটি অ্যালবামগুলো দেখতে দেখতে, গানগুলো শুনতে শুনতে পড়ো। আসলে আমিও ছড়াতে মেশাতে খুউব ভালবাসি - কিংবা আমি খুব বাজে লিখি। প্রথম অ্যালবাম সংবিঘ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক- এর কভার টি দেখা যাক। কভারে একটা প্রায় সিহর্স, কলকাতায় এখন পড়তে আসা কোনো ছেলে মেয়ের মেসের দেওয়ালে যে ধরনের সিহর্স আঁকা থাকে মহীন বোঝাতে, তার থেকে কিন্তু অনেকটা আলাদা। পোষ্টারের সিহর্স এর ডানা আছে এবং অনেকটাই যেন নিবের পড়ে যাওয়া কালির ছাপের এক্সটেনশন মনে হচ্ছে- এবং মোটেও বর্তমান দিনের মতো ফসিলিক ছবি নয়। পেছনে একটা চাঁদ (সূর্যও হতেই পারে) তার তলে একটা ক্যাকটাস বাকিটা ধূধূ মরু। কলকাতা বিষয়ক অ্যালবামে কলকাতাই কি তাহলে মরুভূমি? মাঝে একটা ঘোড়া উড়ুক্কু, জলে থাকে মরুতে সে বাঁচবে কেমনে? তাই কি এই উৎকণ্ঠা! কে জানে অদ্ভুত ম্যাজিক রিয়ালিজম। দ্বিতীয় অ্যালবাম অ উ ব কভার এ লেখা একটা বয়ান তার তলে সাত ঘোড়ার টিপছাপ। তৃতীয় অ্যালবাম দৃশ্যমান কভার এ লেপ্টে অদ্ভুত রকমের রোগা ও প্রায় অর্ধনগ্ন লোক, কিংবা ওগুলো হতেই পারে হটপ্যান্ট- ঠিক বোঝা যায় না, গুলিয়ে ফেলি। এই যে তিনটে অ্যালবাম কভারগুলো কী অদ্ভুত, আসলে প্রচন্ড নতুন- তাই বরং বলা যেতে পারে প্রচণ্ড অজ্যামিতিক তাই নতুন, কিংবা বলা যেতেই পারে প্রচণ্ড রাষ্ট্রবিরোধী তাই অজ্যামিতিক। এই যে মহীনরা বাংলায় প্রথম ননসেন্স ইমেজারি অফ মিউজিক প্রতিষ্ঠা করল (এটি মোটেও ননসেন্স লিরিক্স কিংবা ননসেন্স সাউন্ড নয়, সেইদুটিই বাংলা গানে প্রথম প্রয়োগ করেছে শিলাজিৎ, এবং স্যাটায়ার ও ননসেন্স যে বেশ আলাদা সেটাও মাথায় রাখতে হবে।) তা এক গোত্রীয় মানুষদের সাবকনশাস খুঁড়ে, আদতেই বাস্তবতার হাজারো রং টেনে আনল, আনতে সক্ষম হল, রাষ্ট্রের হাতে নির্মিত স্থিতিশীল বাস্তবতার জড়তা ঘুচিয়ে এক স্বপ্ন রূপক (ইমেজারি) ও তার রাজনৈতিক অনুবাদ হিসেবে তৈরি হল গানগুলোর লিরিক্স ও মিউজিক।

 রাজনৈতিক লিরিক! লিরিক বলে লিরিক! তাতে হাজারো নেমড্রপ ফার্ষ্ট গানেই এত্তজান্তা ভাব! রবিশঙ্কর থেকে বিটলস সবার নামই উল্লিখিত। এতে তাদের শোনার পরিসর যেমন ফুটে উঠছে, একই সঙ্গে এসব না শোনা একজনের সঙ্গে কি একধরনের হায়ারার্কি গড়ে উঠছে না? অবশ্যই গড়ে উঠছে তবে তা ইচ্ছাকৃত নয়, বরং বস্তুগত। এই যে আগের প্যারাতেই বললাম, একটা গোত্রের দিকে হাত বাড়াতে পারে - খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপিটাল সম্পন্ন কেউ এই গোত্রভুক্ত। আস্তে আস্তে যদিও দেখা যাবে, যে অন্য অ্যালবামে হয়তো তারা একদম শ্রেণী চরিত্রের দিকে ঝুঁকে গান লিখছে, কিন্ত গানের ফর্ম? তার পাল্লাও কি শ্রেণী পাক্ষিকে ঝুঁকছে? আমি এখানে মোটেও ভালো করেছে, না খারাপ করেছে, এই বাইনারি সেট করতে বসিনি। কিংবা কীরকম করা যেতে পারত সেসব নিয়ে আলোচনা করতেই বসিনি। বসেছি আমার কীরকম কী মনে হয়েছে এবং একধরনের বিশ্লেষণ দিতে। 

প্রথম গান লিংক ক্লিক করে শুনে নিন ঝটপট, তারপর আসুন। গানটার দৃশ্যপট অনেকটাই বর্তমানে ইনস্টাগ্রামের রিলে দেখানো অ্যাস্থেটিক কলকাতার দৃশ্যের মত, কিন্তু ওই চার লাইনের একটা মোচড় আছে। হঠাৎ করে বলছে কিচ্ছু ভালো লাগছে না! না লাগার কারণ দেখতে পাচ্ছে কৃষক ও শ্রমিকদের ঘাম জড়ানো লিকলিকে ঠ্যাং যেন জড়িয়ে পড়ছে, মাথায় শোষণ যে কতটা বাস্তব তা বুঝে নিচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই চার লাইনের মাধ্যমে শুধু বুঝেই ছেড়ে দিচ্ছে না, বরং গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার ডাককে আরো দুর্দমভাবে লিখছে ‘সেদিন কাছে এসো ভালবাসি সবকিছু একসাথে’। মনে রাখতে হবে, প্রথম বারে গাওয়া হল- সেদিন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেশি দেরি নয় এমন একটা দিন। কারণ পরিকল্পনা চলছে,  বিপ্লব অনেকাংশে সুনিশ্চিত, মনে মাথায় সেই দিন অত্যন্ত নিকট। অ্যালবামটির বাকি গানগুলোর মধ্যেও এই শূন্যতা উদাসীনতা ফুটে উঠছে। উদাসীনতা খানিক ঘরকুনোও হয়ে পড়ছে, কিন্তু তারপরেই কষ্ট আবার ফুঁপিয়ে উঠছে। এই অ্যালবামটির সঙ্গে প্রকাশিত বুকলেটের শেষ লাইন হিসেবে লিখে যাচ্ছে, ‘কিন্তু আপাতত শূন্যস্থানের পরে মহীনের ঘোড়াগুলি’। এই বুকলেটেই প্রকাশিত উৎসর্গের অনুচ্ছেদটি পরে তাঁরা নিজেদের ম্যানিফেস্টো হিসেবে স্বীকার করেন। ফলত সেদিকেও চোখ রাখা প্রয়োজন। পড়ে নিন নীচে ছবি আছে, অদ্ভুত সাইকেডেলিক। এই প্রসঙ্গটি কেউ আগে তোলেনি- এই সাইকেডেলিয়ার বিষয়টি। একটি অংশ উল্লেখ করি, ‘সেইসব ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন, স্বপ্নের ভেতরে ঘুম, আর তার মধ্যে থেকে স্পন্দিত হতে থাকে সিমফনিক ইমোশনস, যাকে বলি সংবেগ; সংবিগ্ন পাখিকুল উড়ে যায়। উড়ে যায় কিন্তু কোথাও যায় না। নীচে ঘুমন্ত পৃথিবী নক্‌শী শতরঞ্জের ছকের মতো পড়ে আছে; নয়ানজুলিতে শাদাশাদা ভয়ঙ্কর হাড়গোড়,বাতাসে ষড়যন্ত্রময় শ্বাসশব্দ আর ক্ষুধার্ত মানুষেরশ্বাপদপ্রতিম চোখ, চোখগুলি, ঘুমহীন, যৌথভাবে জেগে আছে।’ এখানে তারা দর্শক কিংবা চিন্তক কিন্তু অদ্ভূত ভাবে শ্রেণী ঘেঁষা, বলছে সেই শোষিত চোখগুলো যৌথ- অর্থাৎ কিছু একটা ঘটছে, কিছু একটা খসখসে, কিংবা খানিক ঘষা ভিতর থেকেই, বেশ আঁচ পাচ্ছে। ম্যানিফেস্টো থেকে আরেকটা লাইন উল্লেখ করা যাক-  ঘোড়াদের চরিত্র আরও স্পষ্ট হোক,‘মহীনের ঘোড়াগুলির খুরে কোনো নাল নেই।’ বাজারিকরণের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে জীবনানন্দের লাইন ব্যবহার করে যাদের নাম, তারা অব্যহত রাখলো সেই ধারাবাহিকতাকে। জীবনানন্দও বাজারীকরণের বিরুদ্ধেই ছিলেন। এরা এখানে রূপকের মাধ্যমে তাই বলছে, আরও স্পষ্ট করছে, আবার বছর কুড়ি পর অ্যালবামটির বুকলেটে এই লাইনকে কোট করেই।


দ্বিতীয় অ্যালবামে বিষয়টি আরো দৃঢ়। ফুল সাইকেডেলিক কিন্তু নিজেরাই হয়ে যাচ্ছে কেরানি। অর্থাৎ ডিক্লাস হচ্ছে। এখানে একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটছে যা সচরাচর খুব কমই ঘটে থাকে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এই অ্যালবামে স্পষ্টতই নেশার সঙ্গে শ্রমশক্তি পুনুরউৎপাদনের যে রিলেশন, সেই ডায়ালেক্ট ধরে তৈরী হল অ উ ব। কেরানিরা নেশা করে যে গান গাইছে, সেখানে ফ্লায়িং সসার কেন? ইউএফও প্রোপাগান্ডা- সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ছড়ানো হতে শুরু হয়। সেইসময় দুটো ঘটনা সমান্তরালে হচ্ছে। মাস মিডিয়াম হিসেবে সিনেমা সাইন্স ফিকশন, কমিক্স এগুলোর উত্থান, এবং আরেকদিকে বিভিন্ন যুদ্ধ অস্ত্রের উন্নীতকরণ ও পারমাণবিক অস্ত্রের উত্থান। প্রথমত সামরিক এই কার্যকলাপ গুলো ঢাকতে পরীক্ষাধীন যুদ্ধবিমানগুলোই বুর্জোয়া পুঁজি চালিত মাস নিউজে হয়ে যেত এলিয়েন যান। আস্তে আস্তে থ্রেট অ্যাংজাইটি ছড়ালো। এবং সেইসময়ের ছড়ানো প্রোপাগান্ডাগুলোর মধ্যে আরেকটি হল যে, কমিউনিস্টরা খুব খারাপ, বন্দুক বোঝে কেবল, এবং তাদের এই কঠিন কঠিন সব তাত্ত্বিক বক্তব্যের পিছনে আসল সবকিছু ফাঁপা। এইরকম মানসিকতার ছাপ তখনকার আর্ট মিডিয়াম গুলোয় স্পষ্ট। ফলত এই দুই প্রোপাগান্ডা ক্রমশ ব্লেন্ড করে যেন কমিউনিস্টরাই হয়ে উঠল এলিয়েন- তারাই যেন সর্বোচ্চ থ্রেট। কোল্ড ওয়ারে ইডিওলজিক্যালি এগোলো ইউএসএ। হয়তো মহীনের ঘোড়াগুলি এই পুরো বিষয়টির ক্রিটিক করেই গাইছে কেরানীরা নিত্য নেশা করে সেই অ্যালিয়েনগুলোর সঙ্গে যেন গল্প গাছা করে- কমিউনিস্টরা যেন তাদেরই সংস্রব, সে পাড়াতুতো হোক, বা খুড়তুতো। কিন্তু নেশা করেই কেবল কেন দেখা পাচ্ছে? এমনি সময় কোথায় তারা! আসলেই হয়তো সেসময়কার বাংলায় তথাকথিত বাম দল সিপিআইএম এর ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক কাম কারবার উন্মোচিত হচ্ছে, মানুষের থেকে বিছিন্নও হচ্ছে- এইজন্যেই কি এরকম ভাবে ফ্রেম করা গানের কথাগুলো? আমি সেরকমটাই ধরে নিচ্ছি। ‘এ নেশা কি যে নেশা বোঝে কি আনজনে?/শোষণের রাজনীতি করেছি প্রাণপণে।’ 

অ্যালবামটির নেক্সট গান, প্রথম লাইনটিই হলো 'শুধু আজ নয় প্রতিদিন'। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর প্রথম চ্যাপ্টারের প্রথম লাইনটার কথা মনে পড়ে, ‘The history of all hitherto existing society is the history of class struggles.’ যেন এই গভীর লাইনটির সবচেয়ে সহজ ও সুন্দর বাংলা অনুবাদ গানের এই লাইনটি। এখানে যদিও মহীনেরা নিজেদের সেই দোদুল্যমান শ্রেণীতে বসিয়ে দুলিয়ে দিয়েছে। শেষ লাইনে তারা এই যে নিত্য শোষণ, এটাকে মান্যতা দেবে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এখানে তাহলে তারাটা কারা? নিশ্চয় যারা শোষণ করছে তাদেরকে সুধীজন সম্বোধন করলে, তাদেরকে দিয়ে তাদেরই করা শোষণের যথার্থতা নির্ণয়ে বসাতো না। আমার মনে হয় এখানে সেই সেকশনটাকে অ্যাড্রেস করেছে, যারা একভাবে শোষণ খানিক হচ্ছে- এবং তারা তা বুঝতে পারে, কিন্ত তার তীব্রতা বা উৎস সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। এই না ধারণার জন্যেই তারা হয়তো কমরেড হয়ে উঠতে পারছে না, হচ্ছে সুধীজন।যদিও পরে ক্ষ্যাপার গান অ্যালবামে যখন এটি রিপাবলিশ হয় তখন শেষ অংশ বদলানো হল। প্রশ্নটা মান্যতা দেওয়ার রইলো না, বরং নিজেদের দিকে তাকিয়ে কি একটুও লজ্জা ঘেন্না হয় না- এরকম হয়ে গেল। তাহলে এই দুই শতকে সিপিআইএম ভাঙ্গা নকশাল হয়ে সিপিএসআইএমএল, এবং তাও বিভিন্ন টুকরোতে ভেঙ্গে যাওয়ার মাধ্যমে, সমাজবদলের কমরেডদের মধ্যে কি অন্তর্দ্বন্দ্ব বেড়ে বৈরী সম্বন্ধ প্রকট হওয়ার নির্দেশক- নাকি সুধীজন সম্বোধনটা এখন ঘুরে কোনো পুঁজিপতির ব্যাঙ্গাত্মক সম্বোধন হিসেবে সূচিত হল! 

গান দুটি ছাড়াও এই অ্যালবাম এর আরেকটা দিক, যেটি হল এর কভারটা- তাতে লেখা একটা ছোট্ট বয়ান। সেই বয়ানে বলা হচ্ছে, ‘আপনার ডাংগুলি লাঞ্ছিত ছেলেবেলা,... আমরা আপনার সাথে নিবিড় হবো ও অনন্ত একাকিত্ব থেকে আপনাকে উদ্ধার করে আনবো । ফলত আমরা নিজেরা, বেয়াল্লিশ ফুট উঁচু ঝুলবারান্দা থেকে নীচে কেৎরে পড়ে যাবো, চুরমার হয়ে যাবো…’। প্রথম অংশটার থেকেই বোঝা যাচ্ছে সময়টায় ইউনিফর্ম ফ্যমিলি বিল্ড হওয়া শুরু হয়েছে, কালেক্টিভিটি কমছে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে এর ফলাফল ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়া, একাকিত্ব। মহীনরা স্পষ্টতই সেখান থেকে উদ্ধারের দায়িত্ব নিচ্ছে এবং সেই পন্থার সম্বন্ধেও বলছে যে তারা ঝাঁপ দেবে, হায়ারার্কিগুলো ভেঙে নিজেদেরকে শ্রেণী সচেতন করে তুলবে, মিশে যাবে মাটিতে- বাস্তবের মাটিতে, ঘামের মাটিতে, যেই মাটির দল্লা শ্রমিকমহল্লার রুগ্ন শিশুটি বিনা বাধায় আনন্দে মুখে পুরে নিয়ে ফিক করে হাসে।



তৃতীয় অ্যালবাম। দুটি গান। তারপর পুরো কুড়ি বছর দেখা নেই। তৃতীয় অ্যালবামে তো বলেছিল আমরা এখন থেকে আরো স্বচ্ছ ভাবে ধরা দেবো। স্বচ্ছতা বলতে শ্রেণী স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, সংগ্রামী স্বচ্ছতা। অ্যালবামের নামও হল দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি। সাইকডেলিয়ার লেশ নেই। প্রথম গান চৈত্রের কাফনে ছিল লড়াইয়ের স্মৃতি, সত্তরের কলকাতায় যে নকশাল বন্ধুদের ফেলে আসতে হয়েছিলো রাজপথে-গলিতে, যে বন্ধুকে ফেলে আসতে হয়েছিল পাঁচিলের ওপারে কিংবা গোপন মিটিংয়ে। তাদেরকে মনে করতে আর সেই মনে করা লুকিয়ে ফেলার গান। এর মধ্যে দিয়েই লড়াই করে যাওয়ার বিষয়ে আরো দৃঢ় সংকল্প হয়ে গাওয়া হল দ্বিতীয় গান - এই সুরে বহুদূরে। সময়কে ভেদ করে একটা কিছু তো থাকে। সেটিই হল লড়াই, পুরানো ও নতুনের মধ্যে দ্বন্দ্ব - ঘষাঘষি ও ঘেঁষাঘেষি দুইই। এই গানটা শুনলেই, যেমনভাবে আমার বারবার মনে পড়ে- রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালোর কথা। কী অসাধারণ মিল, এরাও তো একই কথা বলছে- সব সরাবো সব সরাবো যা আছে পুরানোতেই। কিন্তু এরা এও বলছে, একটা নতুন কোনো সুর, যা নতুন, যা ঘাতক, আবার যা সংগঠকও। সেইসময়ে দাঁড়িয়ে নকশাল পন্থার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে হাজারে হাজারে ছেলে মেয়ের দিনবদলের যে সংগ্রাম তাকে কী করে অস্বীকার করি! পুলিশি এনকাউন্টারে অত্যাচার- মাজা ভেঙে গেলেও তো পেছনে ফেরেনি তারা। সেইসব দিনকালের ব্যাপারে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন যে, ‘বিএসসি'র পর মণিদা সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ল রাজনীতিতে। গান-বাজনা প্রায় বন্ধ। আমিও তখন বি ই কলেজে নকশাল আন্দোলনে নাম লিখিয়েছি। নিয়মিত পোস্টার লিখছি, 'দেশব্রতী' পড়ছি। ছোট ছোট 'মুভমেন্টে' অংশ নিচ্ছি। মধ্যে মধ্যে পুলিশ ঢুকছে কলেজে। গানবাজনা হচ্ছে বটে। কিন্তু রাজনীতিই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। মনে আছে, একবার কোনও একটা ঘটনায় কলেজে পুলিশ ঢুকল। আমাদের ৮১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গাড়িতে ওঠার সময় অকারণে বন্দুক দিয়ে আঘাত করা হচ্ছিল। শিবপ্রসাদকে মারার সময় বন্দুকের বেয়নেট ওর উরুতে ঢুকে গিয়েছিল। রক্তারক্তি ব্যাপার! সেই অবস্থাতেই আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। অকথ্য অত্যাচার চালায় পুলিশ। বেশ কিছু দিন দমদম সেন্ট্রাল জেলে কাটিয়েছিলাম সে বার।..মণিদার সঙ্গে তখন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। মাঝে মধ্যে দেখা হলে 'রেডবুক' পড়া হতো একসঙ্গে। আলোচনা হতো রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। ক্রমে ক্রমে ও চলে গেল আন্ডারগ্রাউন্ডে। কৃষক ফ্রন্টের হয়ে তখন ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামে গ্রামে। চাষিদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছে। ধানের বীজ পোঁতা শিখছে। ধান মাড়াইয়ের গান গাইছে। শহরের সঙ্গে কোনও সংস্রবই নেই।’ বোঝাই যাচ্ছে কেন গান কিংবা গোঙানি কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু নকশাল আন্দোলন তো আর বছর কুড়ি চলেনি।  তাহলে কেন এই কর্মবিরতি? যে আশায় বুক বেঁধে লড়াই-এ নেমেছিল, সেই লড়াই যখন স্তব্ধ তাহলে এতদিন কি কেবল শোকার্ত হয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায়? সেই গমগমে লড়াইয়ের আশা ছিন্ন হলেও, সমাজের ভিতরের দ্বন্দ্ব গুলো কি আর টানবে না ঘোড়াদের! এর জবাব দেয় বছর কুড়ি পর অ্যালবাম প্রকাশ করে। তারা সেখানে লেখে, ‘ভাবছেন বুঝি, ওরা এখন রেসেরঘোড়া... ক্যালিফোর্নিয়া, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা রেসের মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, পয়সার দৌড়, যার যার পেশার দৌড়। গানের মাঠে তারা আজ কোথায়?? ...পেশার দৌড় না নেশার দৌড়, বন্ধুরা কে কোথায় দৌড়াচ্ছে বলা শক্ত। বেঁচে আছে যখন, দৌড় নিশ্চয়ই আছে। তবে একটা কথা ঠিকই বলেছিলেন, হে সমালোচক। ‘গানের মাঠে’ আমরা নেই। ছিলামও না কোনোদিন। কারণ, গানকে আমরা হাটের মাঠ বানাতেই চাইনি। খোঁজ নিলে জানবেন আমাদের প্রথম মানিফেস্টো তে লিখেছিলাম: “উল্লেখ্য, ঘোড়াদের খুরে কোনো নাল নেই।” তবে আর ‘গানের মাঠ’ কেন, বললুমই তো কোনো নাল নেই, জুতো নেই, পায়ের মাপ নেই, করো কারো পা -ই নেই।’ এর দ্বারা আরো জোরদার ভাবে অ্যান্টি এসটাব্লিশমেন্ট-এর চেতনা মূর্ত হয়। আমি তাদের কী করে এক করে দেবো? ওরা তো তরল, মন আর সময়ের সাপেক্ষে নিজদের বাস্তবতার রূপ বদলায়। আমার কাছে খানিক- উপরে যেভাবে বলার চেষ্টা করলাম- সেভাবে ধরা দিয়েছে।




যা যা বললাম এতক্ষণ সবই প্রথম পর্ব বলা যায়। দ্বিতীয় পর্বের কাজ নিয়েও লেখার ইচ্ছে ছিল, ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে এর মধ্যে লেখা হলো না যেমনটা শুরুতে কথা দিয়েছিলাম। যাইহোক আবার নয় নতুন করে পিনিক নিয়ে অন্য কোনো লেখায় ফেরা যাবে।

 

  

 

 

Comments