বাংলা গানের ইতিহাসে কবীর সুমন

- মোহনা 


বাংলা গানের ইতিহাসে কবীর সুমন এক অনন্য নাম। তিনি শুধু গায়ক বা গীতিকার নন, তিনি এক স্রষ্টা, এক আন্দোলনকারী, যিনি বাংলা আধুনিক গানকে এক নতুন পরিচিতি দিয়েছেন। আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তাঁর আগমন যেন বাংলার সাংগীতিক আকাশে প্রবল ঝড়ের মতো ছিল।


নব্য সংগীত আন্দোলন:

১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। এই অ্যালবাম শুধু একটি গানসংগ্রহ ছিল না, এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তিনি গিটার হাতে নিজের জীবনের কথা, সমাজের সত্য কথা খোলাখুলি গাইছেন। “তোমাকে চাই”, “খুদার কসম জান”প্রভৃতি গান তৎকালীন তরুণদের হৃদয়ে ঝড় তোলে। মানবিকতার মৃত্যু তার গানের মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল। সামাজিক নিপীড়ন থেকে শুরু করে নারী ধর্ষণ, রাজনীতি, সব ঘিরেই রয়েছে তার বহু গান। এই গানগুলোই যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষদের সম্বল হয়ে দাঁড়ালো যাদের কন্ঠস্বর হারিয়ে গেছে নিপীড়নের সামনে।

কবীর সুমনের গানে ব্যক্তিগত অনুভূতি যেমন আছে, তেমনি আছে সামাজিক প্রতিবাদ। প্রেম, একাকিত্ব, হতাশা, রাজনীতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন—সবকিছু তাঁর গানে উঠে এসেছে সহজ অথচ অনন্য ভঙ্গিতে। তাঁর গান কখনও গল্পের মতো, কখনও কবিতার মতো।


রাজনীতি ও সমাজচিন্তা

কবীর সুমন শুধু শিল্পী নন, তিনি একজন সমাজসচেতন মানুষ। ২০০৯ সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হন। যদিও রাজনীতির মাঠে তিনি স্থায়ী হতে পারেননি, তবু তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা সব সময় স্পষ্ট হয়েছে তাঁর গানে।

আজও নতুন প্রজন্ম যখন বাংলা গান শোনে, তখন কবীর সুমনের প্রভাব স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়। নচিকেতা, অনুপম রায়, অর্ণব, কিংবা বর্তমান তরুণ গায়ক-গীতিকারদের সৃষ্টিতে সুমনের ছায়া আছে।

কবীর সুমন শুধু একজন গায়ক নন, তিনি একটি যুগের নাম। তাঁর গান মানুষকে ভাবতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়, প্রতিবাদ করতে শেখায়। 


আমি চাই 

 “আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।”

এই একটিমাত্র পঙ্‌ক্তি যেন জাগিয়ে তোলে এক নিদ্রিত পৃথিবীকে।

বাংলা গানের জগতে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত কবীর সুমনের গানওলা ভলিউম ১ ও ২ যেন এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এর মধ্যে “আমি চাই” গানটি আজও এক অনন্য দলিল—একজন শিল্পীর স্বপ্ন, প্রতিবাদ আর নৈতিক অবস্থান। গানটি আসলে এক ম্যানিফেস্টো, যেখানে ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষার স্রোতধারা প্রবাহিত হয়েছে।এখানে একক শিল্পীর কণ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষের সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি। সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, ভাষা ও পরিবেশ—সবকিছুর সীমারেখা ভেঙে গানটি নির্মাণ করে এক বিকল্প পৃথিবীর স্বপ্ন।

'আমি' মাধ্যমে 'আমরা'

গানের শুরুতেই “আমি চাই”উচ্চারণটি যতবার ফিরে আসে, ততবার ব্যক্তিগত চাওয়া ভেঙে গিয়ে পরিণত হয় এক সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষায়। এই ‘আমি’ কেবল কবীর সুমন নন, এ ‘আমি’ সাঁওতাল মানুষ, নেপালি তরুণ, ঝাড়খণ্ডের শ্রমিক, কাশ্মীরের বন্দি, কিংবা এক হিন্দু নেতার মুসলিম বধূ। তিনি যেন সমস্ত নিঃশব্দ মানুষের কণ্ঠ ধার নিয়ে উচ্চারণ করছেন তাদের নীরব আর্তি। 


বহুত্বের স্বপ্ন :

গানটিতে আমরা দেখি সাঁওতাল, নেপালি কিংবা ঝুমুর নৃত্যের মতো প্রান্তিক সংস্কৃতির মর্যাদার দাবি। কবীর সুমন কেবল বাংলা ভাষা বা শহুরে পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং স্বপ্ন দেখিয়েছেন এক বহুভাষিক, বহুসাংস্কৃতিক সমাজের। তাঁর স্বপ্নে কলকাতা হয়ে ওঠে সবার মঞ্চ, যেখানে কোনো ভাষা বা পরিচয় প্রান্তিক নয়।

সহিংসতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা:

“আমি চাই”-তে কাশ্মীরের উল্লেখ আসলে এক বৃহত্তর দুঃখের প্রতীক। বন্দুকের শব্দে, রক্তপাতের ইতিহাসে ক্লান্ত মানুষকে তিনি শোনাতে চেয়েছেন নীরবতার সুর। তাঁর দাবি—রাজনীতি আর ক্ষমতার খেলা নয়, মানুষের হাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ। 

বাংলা গানের ইতিহাসে খুব কম শিল্পীই এত সরাসরি ধর্মীয় প্রাচীরের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন। “আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ”—এই লাইন শুনে মনে হয় বজ্রপাত নেমেছে সমাজের মাথায়। এখানে প্রেম ধর্মকে অতিক্রম করেছে, ভালোবাসা হয়ে উঠেছে সর্বশ্রেষ্ঠ সত্য। নব্বইয়ের দশকে এমন সাহসী ঘোষণা একেবারেই বিরল ছিল এবং এই গান সেই নিষিদ্ধ আলোয় আলোকিত।

“গাছ কাটা হলে শোকসভা হবে বিধানসভায়”—এই লাইন আমাদের চেতনার গভীরে নাড়া দেয়। প্রকৃতির ক্ষতি যেন সংসদের ঘটনাও বটে, মানুষের অন্তর্গত ক্ষতও বটে। আবার যখন তিনি বলেন, “পুকুর বোজালে আকাশ ভাসবে চোখের জলে”, তখন প্রকৃতি আর মানুষ আলাদা থাকে না, দুজনেই মিশে যায় এক সত্তায়। গানটি তাই পরিবেশ আন্দোলনেরও এক পূর্বসূরি, যা আজকের জলবায়ু-সংকটের যুগে নতুন অর্থ পায়।

তিন দশক কেটে গেছে। সমাজ আজও বিভক্ত,ধর্মের নামে হত্যা, রাজনীতির নামে হিংসা, প্রকৃতির ওপর আগ্রাসন, প্রান্তিকের প্রতি অবহেলা। এই বাস্তবতায় “আমি চাই” আরও প্রাসঙ্গিক, আরও আগুন-ঝরা। এর প্রতিটি লাইন আজও যেন প্রতিবাদ সভায় স্লোগান, আবার প্রেমের কবিতার মতোই নরম।

শেষে তিনি বলেন, “যদি বলো চাইছি নেহাত, চাইছি নেহাত স্বর্গরাজ্য, আমি চাই একদিন হবে, একদিন হবে এটাই গ্রাহ্য”

গানটি মাধ্যমে বোঝা যায় স্বপ্ন দেখা মানেই প্রতিবাদ করা, আর প্রতিবাদ মানেই নতুন পৃথিবীর সম্ভাবনা তৈরি করা।এটি কেবল কল্পনার স্বর্গ নয়, বরং এক বাস্তব ইউটোপিয়ার খসড়া।


জুয়া 

কোনো একদিন রাত নামলে মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা সবাই এক অদৃশ্য টেবিলে বসে আছি। সামনে রাখা আছে স্বপ্ন, ভয়, প্রেম, সবকিছুই যেন তাসের মতো। কেউ জিতে যায়, কেউ হেরে যায়, কেউ আবার কেবল খেলেই যায়, ফল জানে না। কবীর সুমনের “জুয়া” গান শুনলে আমার মনে হয়, উনি সেই তাসখেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে সবার জন্য কথা বলছেন। যদিও ছাত্র জীবনে এই খেলা যেন একটু হলেও ছাই চাপা দেওয়া আছে।

গানটি বেরোয় ১৯৯৮ সালে, ‘নিষিদ্ধ ইস্তেহার’-এর অ্যালবামে। কিন্তু শোনার সময় মনে হয় না, এটি শুধু সেই সময়ের গান। মনে হয় আজকের রাস্তায় দাঁড়িয়েই লেখা হয়েছে। মনে হয় আমারই ডায়েরি, তোমার অশ্রু, আমাদের সবার আকাশে ভেসে থাকা প্রশ্ন।

সুমন প্রথমেই বলেছেন প্রেমের কথা । প্রেম মানে তাঁর কাছে এক অদ্ভুত জুয়া। “তুমি কি কখন আমার ভাগ্য হবে?”—এই কথাটা কখনো না কখনো মনে হতে বাধ্য। প্রেমে জেতা-হারার হিসাব থাকে না, তবুও আমরা খেলি, হেরে যাব জানলেও খেলি। এখানে প্রেমিকা কেবল শরীরের আহ্বান নয়, বরং এক স্বপ্ন, এক অস্থির অপেক্ষা।

যখন তিনি বলেন মানুষ মহাকাশ ছুটছে, নভোযান থেকে সংকেত ভেসে আসছে,তখন মনে হয় পৃথিবীর বুকেই ঘাস শুকিয়ে যাচ্ছে অথচ আমরা তারাদের পেছনে ছুটছি। সুমনের প্রশ্ন তাই সহজ, কিন্তু শাণিত-এই ছুটোছুটি কি আমাদের বাঁচাবে, নাকি কেবল আরও এক জুয়া? চকচকে রকেটের আলোয় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কৃষকের মাটির ফাটল, শিশুর খালি থালা।

উপসাগরীয় যুদ্ধ হয়ে উঠেছে বিনোদনের প্রতীক। সেই দৃশ্য সুমন ধরলেন তাঁর গানে। যুদ্ধ, গণহত্যা, ধর্ষণ — সবকিছু যেন টেলিভিশনের সিরিয়াল। আমরা চোখ বড় করে দেখেছি, কিন্তু তেমন নড়িনি। আর আজ ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে সেই লাইন “ধর্ষণটাও দেখা যাবে এক্ষুনি” শিউরে তোলে, কারণ অভয়া কাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল — ধর্ষণ সত্যিই হেডলাইনের খাবার, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের উপকরণ। মানবিকতার মৃত্যু ঘটেছে এই লাইন এর দ্বারা। 

কিন্তু অভয়া কাণ্ড শুধু অন্ধকার নয়—সেটা ছিল আগুনেরও জন্ম। ডাক্তারদের মিছিল, মানুষের প্রতিবাদ—এগুলোই প্রমাণ করে সুমনের গান কেবল আশঙ্কা নয়, এক ভবিষ্যৎ ভবিষ্যদ্বাণী। মিছিলে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখেছি মানুষ কে, যারা নিজেদের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেছিল তারাও রাস্তায় নেমে আসে ।

গানের আরেকটি চিত্র আজও স্পষ্ট—মেয়েটি কম্পিউটারে খেলছে, কিন্তু খেলায় শুধু হত্যা, আগুন, দানব। খেলার ছলে শিশুর মগজে ঢুকে পড়ছে সহিংসতার ভাইরাস। আমরা ভাবি এগুলো কেবল খেলা, কিন্তু সুমন আগেই বলেছিলেন —“মগজে এখন শুধু ভাইরাস ঢোকে।” আজ যখন দেখি বাস্তবে সহিংসতা আর উদাসীনতা বাড়ছে, তখন মনে হয় লাইন কতটা দূরদর্শী ছিল। মানুষ বলতে শুধু মানুষ কে না ভেবে তার মধ্যে আছে ধর্ম, জাতি, অর্থনীতি ও সামাজিক বৈষম্য ।

তিনি স্বীকার করেছেন—গান তাঁর নিজের কারফিউর মধ্যে বন্দী ছিল। ক্যাসেট কোম্পানি, বিক্রির হিসেব, বাজারের শৃঙ্খল—সবই শিল্পীর কণ্ঠকে বেঁধে রাখে। কিন্তু সুমন বলেন, এই গানের ভেতরেই তাঁর অভিসন্ধি, তাঁর ষড়যন্ত্র — মানুষকে জাগানো, অন্যায়ের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা, গণঅভ্যুত্থানের ডাক। এই গানের প্রতিটি শব্দ তাই আসলে ভবিষ্যতের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া বোতলভর্তি বার্তা।

অভয়া কাণ্ড যেমন চিকিৎসাক্ষেত্রের অন্তর্লীন অন্ধকারকে সামনে এনেছিল, তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রও আটকে আছে দুর্নীতির জালে। শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি, ঘুষে ডাক্তারি আসন, সবকিছুই এক ভয়ংকর মনোপলি নেটওয়ার্ক। যেখানে স্বপ্ন, মেধা আর মানুষের সেবার স্পৃহা — সবই তাসের টেবিলে বসানো, আর ফলাফল নির্ধারিত হয় টাকার ও ক্ষমতার জুয়ায়। গ্রামে এখনও পৌঁছে উঠতে পারেনি ডক্টর পিছিয়ে থাকা মানুষ গুলো যেনো আরো ঘোর অন্ধকারের ভিতর চলে যাচ্ছে। 

গানটি আবার শেষমেশ ফিরে আসে প্রেমিকার কাছে। কিন্তু প্রেম এখানে নিছক দেহের কামনা নয়, তার প্রেমিকা যেন বিদ্রোহের সঙ্গী। তাঁর স্পর্শে সুমন খুঁজে পান বিদ্রোহের শিখা। যেন প্রেমিকার ঠোঁট থেকে জন্ম নেবে কবিতা, তাঁর শরীর থেকেই জন্ম নেবে বিপ্লব। যেন প্রেম আর বিদ্রোহ এখানে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে।

ভেবে দেখলে পঁচিশ বছরেরও বেশি আগে লেখা একটি গান আজও এতটাই আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। মহাকাশের চকচকে বিভ্রম, টিভির সিরিয়ালে রক্তপাত, ধর্ষণ আর দুর্নীতির খবর, চিকিৎসা-শিক্ষার কাজে দুর্নীতি,সবই যেন সুমনের সেই কণ্ঠে আগে থেকে লেখা ছিল।

“জুয়া” তাই নিছক একটি গান নয়, এটি এক ঐতিহাসিক দলিল। প্রেম থেকে প্রতিবাদ, শরীর থেকে সমাজ, ব্যক্তিগত বেদনা থেকে রাজনৈতিক ক্ষোভ—সবই তিনি এক একটি কথার মাধ্যম বুনেছেন।


ফুলমনি ইশরাত 

গানের প্রথমেই বারবার ফিরে আসে সেই হৃদয়বিদারক পংক্তি—

“ধরা পড়ে যায় দেহটাই শুধু, ধরা পড়বে না মন।”

এই লাইন যেন একদিকে ব্যক্তিগত শোক, অন্যদিকে সামষ্টিক ইতিহাস। দেহ নিঃশেষ করা যায়, কিন্তু মন, স্মৃতি, লড়াই কখনও নিঃশেষ হয় না।

কবীর সুমন এখানে এক অদ্ভুত সমান্তরাল তৈরি করেছেন। ইশরাত জাহান একজন মুসলিম তরুণী, ফুলমনি একজন হিন্দু মেয়ে। দুজনকেই তিনি ডাকেন “আমার ছোট্ট বোন” বলে। এখানেই নিহিত গানের মূল প্রশ্ন—কেন আমাদের সমাজে বোনের সংজ্ঞা ধর্মের খাঁচায় আটকে যায়? এবং কেন মুসলমান মেয়েটি রাষ্ট্রের চোখে এত সহজে হয়ে ওঠে ‘সন্ত্রাসবাদী’?

এই দুই মেয়েকে পাশাপাশি বসিয়ে সুমন যেন আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ভারতের দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নগ্ন রূপ।

ভারতবর্ষের সংবিধান বলে, আমরা সবাই সমান নাগরিক। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে? মুসলমান নামটা সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের চোখে, প্রতিবেশীর চোখে, এমনকি বন্ধুর চোখেও হয়ে ওঠে সন্দেহের কারণ।

ইশরাত জাহানের মৃত্যু তাই নিছক পুলিশি ভুল নয়। এটি এক দীর্ঘ দিনের সামাজিক অভ্যাসের প্রতিফলন—যেখানে মুসলিম মানেই সম্ভাব্য অপরাধী, সম্ভাব্য সন্ত্রাসী।

গানের একটা জায়গায় সুমন তীব্র আঘাত করেছেন—

“বুকের আগুন বাঁচিয়ে রাখাকে সন্ত্রাসবাদ বলে।”

ইশরাত জাহান গুজরাটে এক এনকাউন্টারে নিহত হয়েছিলেন। সরকারি ভাষ্য বলেছিল — তিনি নাকি সন্ত্রাসী, হাতে ছিল একে-৪৭। কিন্তু সুমন এখানে সেই সরকারি কাহিনিকে প্রশ্ন করেছেন।

আসলে ভারতে বহু বছর ধরে মুসলমানদের সহজেই সন্দেহভাজন বানানো হয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, সংবাদমাধ্যমে, পুলিশের তদন্তে—বারবার তারা সন্ত্রাসের ছায়ার সঙ্গে জুড়ে যায়। ইশরাতের মৃত্যু তাই শুধু একজন মেয়ের মৃত্যু নয়, এটি রাষ্ট্র-সমাজের এক বড় ভাঙনের প্রতীক। অথচ ইশরাত, যিনি মুসলিম, তার মুখে বিদ্রোহ দেখলেই তাকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করা সহজ।

এই বৈষম্যের যন্ত্রণা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যেই আছে। মুসলিম ছেলেমেয়েরা ভালো চাকরি পেতে বাধা পায়, ভাড়া বাড়ি নিতে গিয়ে অস্বীকৃতি শোনে, একা রাস্তায় চললেও পুলিশি জেরার শিকার হয়, এমন কি আমাদের অতি চেনা মানুষের মুখেও শুনতে পাই মুসলিম দের প্রতি কটাক্ষ,গানের ভেতর দিয়ে এই তীব্র বাস্তবতাই ভেসে ওঠে।

সুমনের গান গুজরাটের দাঙ্গার ক্ষতকে সামনে আনে, যেখানে মুসলমানরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু কেবল গুজরাটেই কি থেমে আছে? আজও একই আগুন নেভেনি।

CAA আন্দোলনের সময় মুসলিম তরুণীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলেন — আমরা কি এই দেশের নাগরিক নই? দিল্লি দাঙ্গার আগুনও একই কথা বলেছিল।ইশরাতের মৃত্যু আর ফুলমনির নিরাপদ জীবনকে একসাথে টেনে এনে সুমন যেন বলছেন — এ দেশ যদি সত্যিই গণতন্ত্র হয়, তবে মুসলিম মানেই শত্রু এই ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতেই হবে।

সুমন গানে স্পষ্টই বলেছেন—

“ভেতরে আগুন বাইরে আগুন গুজরাট হয়ে জ্বলে।”

এই লাইন শুধু ব্যক্তিগত নয়, সরাসরি ইতিহাসের দিকে আঙুল তোলে। গুজরাটের দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ, মুসলমানদের ওপর অব্যাহত আক্রমণ—সবকিছুই প্রতিধ্বনিত হয় এখানে।

গুজরাটের দাঙ্গা আর তার পরিণতি আমাদের শেখায়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কিভাবে সাধারণ মানুষকে ভেঙে দেয়।

রাষ্ট্র যখন মুসলমান নাগরিককে সমান চোখে দেখে না, তখন আসলে ভেঙে যায় গণতন্ত্রের ভিত্তি।এক ফুলমনি, এক ইশরাত—দুজনেই তো বোন। তবু ধর্মভেদে কেন তারা আলাদা হয়ে যায়? এ প্রশ্ন শুধু গানের নয়, আমাদের সমাজের।

ইশরাতের এনকাউন্টার নিয়ে বহু তদন্ত হয়েছে, অনেক মামলা চলেছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত ন্যায়বিচার কি হয়েছে? প্রশ্নটা আজও খোলা রয়ে গেছে। আর সেখানেই সুমনের ক্ষোভ।

তিনি বলেন, এমন মৃত্যু, এমন অন্যায়, এমন চেপে রাখা কান্না—এসবের প্রতিদান শুধু ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা?

এখানে আমি নিজের অভিজ্ঞতা মেলাই — আমরা তো প্রায়শই দেখেছি, খবরের কাগজে বড় শিরোনাম হয়, কিন্তু কয়েকদিন পরেই সব চাপা পড়ে যায়। শহরের ব্যস্ততায় মুছে যায় নাম, মুখ। কিন্তু সুমন সেই মুখকে গানে ফিরিয়ে আনেন, যেন ইতিহাস চাপা পড়ে না যায়।

সুমন নিজেই স্বীকার করেছেন, গান দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাঙা যায় না। তবুও গান হল প্রতিরোধের কণ্ঠ।

“তোমার লড়াই আমার কণ্ঠে গানের জীবনবোধ।”

এই লাইন যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় — প্রতিরোধ মানেই শুধু অস্ত্র নয়, প্রতিরোধ মানেই শুধু মিছিল নয়, প্রতিরোধ গড়ে ওঠে কবিতায়, সুরে, স্মৃতিতে।







Comments