সংগ্রাম ও সলিলঃ কিছু কথা

সুদিঠি ভট্টাচার্য 


স্কুলের শেষ গানের পরীক্ষায় “পথে এবার নামো সাথী” গেয়েছিলাম। নন্দিতা দি, দেবাংশু স্যার আর সুমন্ত স্যার বাহবা জানিয়েছিলেন। প্র্যাক্টিকালে ফুল মার্ক্স পেয়েছিলাম হয়তো দৃপ্ত কন্ঠে সেই গান গাওয়ার জন্যই। এই অনিশ্চয়তার দুর্দিনে সেই মানুষটিকে বারবার স্মরণ করি, যার “ঘুম ভাঙ্গানো” গান হয়ে উঠেছিলো শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্য সংগ্রামের প্রতীক।  

“যখন প্রশ্ন ওঠে যুদ্ধ কি শান্তি

আমাদের বেছে নিতে হয় নাকো ভ্রান্তি

আমরা জবাব দিই শান্তি শান্তি শান্তি।।“

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় এই গান লিখেছিলেন সলিল চৌধুরী। পৃথিবীটা পালটায়নি খুব একটা। তাই, এই লাইনগুলো আজও খুব প্রাসঙ্গিক। কঠিন সময়ে তাঁর জীবনমুখী গান হয়ে ওঠে “আলোর পথযাত্রী”। ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার সাহস আর ভরসা যোগায়। 

সলিল চৌধুরীর বাবা আসামের চা বাগানের ডাক্তার থাকাকালীন ওই অঞ্চলের চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রা ও সংগ্রামের নানা দিক তিনি ছোটোবেলায়ে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আঞ্চলিক গানের সুরে সিক্ত হয়েছিলেন। শিল্পের সঙ্গে রাজনীতির মেলবন্ধনের কৌশলও তাঁর প্রাথমিক ভাবে বাবার কাছেই শেখা। স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে বামপন্থী আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত হন ও কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। বুঝতে পারেন যে শিল্প ও সংগ্রামের মেলবন্ধনের শিক্ষাকে তিনি প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছেন। প্রখ্যাত গীতস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। গলায়ে গান নিয়ে,  সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক চেতনায়ে শানিত মন নিয়ে সলিল চৌধুরীর যাত্রা শুরু হয়।        

জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সান্নিধ্যে এসে একদিকে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত ও অন্যদিকে পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও লোকসংগীতের সুরে জাড়িত হয়ে জন্ম হয়েছিলো গণসংগীতকার সলিল চৌধুরীর। সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তাঁর “রানার”, “বিচারপতি”, “অবাক পৃথিবী” “পথে এবার নামো সাথী”-র মতো গানগুলো। তেভাগার ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সংগ্রামী মেজাজ ফুটে উঠেছিল তাঁর কথায় ও সুরে -  

“পঞ্চাশে লাখ প্রাণ দিছি

মা বোনেদের মান দিছি

কালো বাজার আলো করো তুমিই না

জান কবুল আর মান কবুল

আর দেবোনা আর দেবোনা

রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।।“

১৯৪৫ সালে তাঁর গানে তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ বিচারপতিদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন – “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা।“। সাম্প্রতিক কালে যেই বিচারহীন পরিবেশে আমরা আছি, এইরকম সময়ে এই গান আমাদের বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে, প্রতিবাদে সোচ্চার হতে শেখায়।

১৯৪৬-এ বর্ণবৈষম্য, কর্মক্ষেত্রের শোচনীয় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ও পর্যাপ্ত খাদ্যের দাবীতে তৎকালীন বোম্বে সহ সারা দেশে নৌবিদ্রোহের জোয়ার ছড়িয়ে গিয়েছিলো। সেই বছরের ২৯শে জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘটের প্রেক্ষাপটে, শ্রমজীবি মানুষের লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে সলিল চৌধুরী লেখেন তাঁর কালজয়ী গান – “ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে”। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যবনিকা পতনের সময় তখন ঘনিয়ে আসছে। 

দেশভাগের সময়ে শ্রমজীবী মানুষকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক হয়ে দাঙ্গার বিরুদ্ধে “মিলনের সেতু” বাঁধার আহ্বান জানান তাঁর “ও মোদের দেশবাসীরে” গানের মাধ্যমে। 

চিত্রকলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা যেভাবে চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও জয়নুল আবেদিনের কাজে ফুটে উঠেছে, সেভাবেই, গানের কথায় সেই বাস্তব রুপায়িত হয়েছে সলিল চৌধুরীর রচনায়। স্বচক্ষে দেখেছিলেন লাখো লাখো মানুষের অনাহারে মৃত্যু। “কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা” গানে, তিনি লিখেছিলেন,

“আষাঢ় শ্রাবণ কি বৈশাখে গাঁয়ের বধুর শাঁখের ডাকে

লক্ষী এসে ভরে দিত গোলা সবার ঘরে ঘরে

হায়রে কখন গেলো শমন অনাহারের বেশেতে সেই

কাহিনী শোনাই শোনো” 

এত কম শব্দে সাংস্কৃতিক জগতে সলিল চৌধুরীর অবদানের কথা লেখা সম্ভব না। গানের জগতে আরও বড়ো জায়গা জুড়ে আছেন সলিল চৌধুরী। কথা ও সুরে তিনি গানের একটি স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরী করেছিলেন। তাঁর গানের আত্মপোলব্ধি ও জীবনবোধের কারণে তিনি সর্বত্র সমাদৃত হয়েছেন। 

আজও “মাঠপাথার, গ্রামনগর, বন্দরে” চলছে লড়াই – সেই লড়াইয়ের প্রাণ হয়ে উঠছে সলিলের গান।


Comments