অঙ্ক কি কঠিন
- অনুরণ
পরিচালক - সৌরভ পালোধি
ডলি, টায়ার আর বাবান। কলকাতা শহরটা ক্রমশ বড় আর উঁচু হতে হতে শেষ হয়ে গেছে ঠিক ওদের বাড়িগুলোর সামনে। সবাই জানে একদিন যখন এই গোটা পৃথিবীটা একইরকম দেখতে বড় বড় ফ্ল্যাটে ঢেকে যাবে, তখন ওরা সবাই হারিয়ে যাবে। ঠিক যেমন বড় গাছ কাটলে হারিয়ে যায় পাখির দল।
বা হারাবে না। ওরা আবার কোথাও গিয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে যাবে নিশ্চিতই। এই গরীব তস্য গরীব লোকগুলোর সমস্যা এইটাই, এরা কিছুতেই পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। জায়গাটা সুন্দর করতে যতবার ওদের ঝেঁটিয়ে সরানো হয় পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, কোথাও না কোথাও ঠিক জমে যায় এরা! সুললিত গৃহসজ্জার আর্বান স্বপ্নের পাশে টপ শটে দেখা যায় ঠিক একটা ঘিঞ্জি বস্তি গজিয়ে উঠেছে। পরম আদুরে সঙ্গীতসন্ধ্যায় মিশে যায় এক বালতি জল নিয়ে খিস্তিখেউড়। দামী আরো দামী হতে চলা লাইফস্টাইলের উদ্ভিন্ন প্রদর্শনীর পাশে একটা কালো নোংরা বাচ্চা চলে আসে ফটোগ্রাফারকে লালায়িত করে। টপ ক্লাস ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একটু দূরে বন্ধ পড়ে থাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘাড় মটকানো লাশ।
ইস্কুলটা উঠে যাওয়ার পরেও ডলি, টায়ার আর বাবানের তাই এই সিনেমাটায় ঢুকে আসা ছাড়া আর কিচ্ছু করার ছিল না। খুব কম বাংলা সিনেমাই আজকাল উঁচু নীলচে ছাদে লালচে বাকচাতুর্য মেশানো সোনালী মদের গেলাস পেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে কচুরিপানা আর বেড়ার দোকানে ভরা ওদের এলাকাটায় ঢোকে। তবে ভাগ্যিস 'অঙ্ক কী কঠিন' ঢুকলো এলাকায়। নাহলে সেই ছেঁড়া কোটপরা পাগলটা যে কাজলের পাশে বসে ম্যান্ডেলিন বাজিয়ে স্বপ্ন স্বপ্ন বিভ্রম তৈরী করে, জানাই যেত না। জানা যেত না তিন পাওয়ার-পুঁচকে অক্সিজেন সিন্ডিকেট ভেঙে শ্বাসবায়ু জমিয়ে রাখতে পারে সব্বার জন্য। বিশেষ করে তাদের জন্য যাদের দম ফেলার সময় নেই, দাম তো আরো-ই কম।
তাই ডলি, টায়ার আর বাবান, এই তিন খেলনা নার্স-ইঞ্জিনিয়র-ডাক্তারের দল একটা হাসপাতাল খোলে। আর তাদের সাথে জুটে যায় শাহরুখ। সরষেক্ষেতহীন কচুরিপানার এই গল্পে ঘুরেফিরে আসে কাজল। গল্পের ভেতর রাতে বাড়ি আসে সমস্তদিন নিজের শরীর ভোগ করতে দিয়ে ফেরা মা। মিছিমিছি ইঞ্জিনিয়র ছেলে তার জন্য বানিয়ে রাখে জাদু কার্পেট। তাই গল্পে সমস্তদিন ইট বয়ে নতুন নতুন ফ্ল্যাট তৈরীর রাজমিস্তিরি বাবার বুকছোপানো কাশি থেকে ভলকে ভলকে যে বাতাস বেরোয়, পুঁচকে ডাক্তার বাবান তাকে রোগ ভাবলেও, সব্বাই জানে এর নাম উন্নয়ণ। ডলি, টায়ার আর বাবানের হাসপাতাল বানানোর গল্পটা তাই সত্যি হওয়াটা দরকার মনে হয় বড্ড।
বড্ড মনে হয় একদিন এরা সব্বাই জিতে যাক। পৃথিবীর সব ফিশফ্রাই সমান তিনভাগে ভাগ হোক। আমরা খেলেই ম্যাজিকের মতো পেট ভরে যায় একজীবন রুটি বেলে চলা যে মায়েদের, তাদের শরীর খারাপ হলে যেন আব্বুলিশ বাড়িতে একটা হাসপাতাল থাকে। সন্ধের আলোজ্বলা এই বিরাট বিরাট হাইরাইজের পৃথিবী থেকে একটু দূরে অঙ্ক করা বাচ্চাটা যেন সত্যিই টিচার হয় একদিন। সত্যি টিচার। হয়। একদিন। সব কাজলের গোছানো হাত যেন সব শাহরুখের অবুঝপনা সামলে রাখে। ভালোবাসার মাঝখান থেকে রাগী বাবার মতো রাজনীতি সরে যায় যেন একদিন।
একদিন। ওই একদিনের ম্যাজিকের ভরসায় বাতিল হাইরাইজের কঙ্কালে প্রাণের আবাহন সাজায় এই মহানগরের হাঁ- এর বাইরে থাকা কটা ফালতু পাবলিক।
আর হ্যাঁ, সৌরভ পালোধি আর সৌমিত দেবের চিত্রনাট্য দুর্দান্ত (প্রায় অহেতুক বাকচাতুর্যবর্জিত), আর দেবদীপের সঙ্গীত বড্ড বড্ড মরমি।
Comments
Post a Comment