রঙিন স্বপ্নগুলো ধোঁয়াশায় ঢাকলো কেন?

- ইশান দাস, Jadavpur University 


"What you think is more important than what’s true."

        ~ Adolescence (2025, Netflix TV Series)


বর্তমান সময়ে আমরা সমাজ মাধ্যমে ‘আডোলেসেন্স’(Adolescence) ওয়েব সিরিজ নিয়ে মন্তব্য ও তার জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে আলোচনা উঠে আসতে দেখতে পাচ্ছি। আসলে এই সিরিজে কথা বলা হয়েছে সমাজে শিশু ও তরুণ অবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়া, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে মানসিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে এক বদলে যাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে ; এমনকি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার (Keir Starmer) পর্যন্ত দেশের সকল নাগরিককে সিরিজটি দেখার অনুরোধ করেছেন।

                                       আসলেই এই ঘটনার মাধ্যমে কী উঠে আসে? কেন এই সিরিজ অত জনপ্রিয়তা লাভ করলো? আসলে এক্ষেত্রে বলা যায়, মানুষ নিজেদের বর্তমান অবস্থান ও মানসিকতার সাথে এক সমতুল্যতা খুঁজে পেয়েছে এই সিরিজটির মাধ্যমে। যা তারা চারপাশে দেখছে ; এক অস্থির পরিবেশ, এক অসুস্থ মানসিকতার বিকাশ। কিন্তু তার সংশোধন বিষয়ে আলোচনা দেখছে না, কেউ সমস্যা বলে চিহ্নিত করে এগিয়েও আসছেনা খোলাখুলি কথা বলতে। তখন মানুষ সমার্থকতা খুঁজে পেয়েছে তাদের মানসিক অবস্থার অবনতি ও পরবর্তী জেনারেশনের চিন্তন ও ভাবনার বিকৃত অস্থির হতাশাজনক প্রবণতার সাথে, ‘আডোলেসেন্স’ (Adolescence) ওয়েব সিরিজটির মধ্যে।

                         আসলে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যখনই আলোচনা করতে বসি শিশু মনে, তরুণ মনে এমনকি যুবা মনেও এই চাঞ্চল্য, এই অস্থিরতা, এই হতাশা, নিরুদ্বেগ কেন বেশি করে বারবার দেখা দিচ্ছে তখন আমরা কিছু প্রচলিত সমস্যার দিকে আঙুল তুলে দায়ভার থেকে মুক্ত হয়ে যাই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এই সমস্যা আসলেই বহুমাত্রিক। এর ব্যপ্তির পরিসর অনেকখানি। পোস্ট কলোনিয়ালিজম, পোস্ট মডার্নিজম, সমসাময়িক রাজনৈতিক চর্চায় নিম্নমেধার রাজত্ব ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল মিডিয়া সব কিছুর প্রভাবের সাথে কীভাবে এই অস্থিরতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে সেই বিষয়ে আমাদের তুল্যমূল্য আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। পশ্চিমী দেশগুলোতে যে কারণে এই অস্থিরতা সৃষ্টি সেই একই কারণ যে প্রাচ্যের প্রতিটি দেশেই প্রতি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে তা কিন্তু নয়, তা জন্ম নেয় বহু কারণের থেকে।

                               প্রথমেই আমাদের এটা মেনে নিতে বাধ্য করা হয়, প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে প্রত্যেকের হাতের মুঠোয় মোবাইল ফোনের আগমন ঘটায় তার ব্যবহারের মাধ্যমই হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অস্থিরতার জন্য দায়ী। আচ্ছা যদি এটিকেই আমরা এক মূলগত কারণ বলে ধরে নিই, তাহলে 'ডিজিটাল ডিভাইড’ বা প্রযুক্তিগত বৈষম্যের মাধ্যমে সেই প্রান্তিক অঞ্চলগুলির জনগোষ্ঠীর প্রতিটা শ্রেণীর শিশু বড় হওয়ার পর্যায়ে যখন এই প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় পাচ্ছেনা, সে বুঝতে পারছে সমাজের এক বিশাল বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তখন তার মধ্যে যে অস্থিরতা কাজ করছে সেই ক্ষেত্রে কি আমরা মোবাইল ফোনের সমাজ মাধ্যমে ব্যবহারকে দায়ী করতে পারবো? কখনোই নয়। তখন এই যন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক অস্থিরতা। সুতরাং, আমরা কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোন সমস্যাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি সেটাও বড় কথা। প্রথমেই যে কারণে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীচেতনা বিষয়ে আমাদের অবহিত হওয়া ভীষণ জরুরি।

                                         এবার আমাদের যখন বোঝানো হয়, পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মানসিক অস্থিরতা ও চঞ্চলতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী হলো এই মুঠোফোনে মুখ গুঁজে থাকা, তাতে প্রদর্শিত অশ্লীলতায় ডুবে থাকা, তখন আমাদের ভাবতে হবে এই আলোচনা উঠে আসছে পশ্চিমী দুনিয়ার সেই সব প্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশগুলির সমাজ বিজ্ঞানীদের থেকে। এবার যদি লক্ষ্য করা যায়, আফ্রিকা মহাদেশের অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের সেইসব তথাকথিত ‘কালো চামড়ার' মানুষদের কথা, তাদের মধ্যে সেই অস্থিরতার কারণ কি সেই একই যুক্তি? কখনোই নয়। আমরা পোস্ট কলোনিয়ালিজমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে পারি, সেই বর্ণবৈষম্য বা পশ্চিমী দেশগুলির থেকে সম্মান প্রত্যাশায় বারবার ব্যর্থ হতে হতে জন্মানো ক্ষোভ থেকে কি জন্মাচ্ছে না অস্থিরতা? যখন সেই কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ দেখছে ইউরোপীয় দেশগুলোতে অথবা আমেরিকাতে কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী, অভিবাসন বিরোধী একের পর এক রাজনৈতিক তত্ত্ব ও প্রচার জনপ্রিয়তা লাভ করছে, 'কালো' অর্থেই অন্ধকার, অসভ্য, পিছিয়ে পড়া, অসুর, দৈত্য, যা কিছু অনিষ্ট, এই সকল চিন্তাধারায় যখন দুনিয়া ভাগ হয়ে যায় এবং যা কিছু সাদা তাই শুভ এই চিন্তনের বিকাশের জগতে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের ক্রমবিকাশকে তুলে ধরতে, সম্মান ছিনিয়ে আনার লড়াইতে বারংবার অসম্মানিত, পিছিয়ে পড়তে পড়তে শিশুমন থেকেই যে এক বিকার জন্ম নেয় যে আমাদের ওই সাদা চামড়ার মতন হতে হবে। এই কথা পোস্ট কলোনিয়ালিস্ট ও মনস্তাত্বিক ফ্রান্ত্জ ফ্যানন উল্লেখ করেছেন তার ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’ বইতে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের মানসিক বিকার ঘটে যাচ্ছে এই প্রতিযোগিতা, এই অসম্মানের মাধ্যমে। যখন অনলাইনেও অমনই সমস্ত বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যে কমেন্ট বক্স ভরে যেতে দেখবে বর্তমান সময়ে সেই কৃষ্ণাঙ্গ শিশু, যে সবে মুঠোফোনের ব্যবহার করছে তার মনে এর কি প্রভাব পড়বে? বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট অস্থিরতা দেখা দেবে, এক্ষেত্রেও আমাদের আরেক পোস্ট কোলোনিয়ালিস্ট হোমি কে. ভাবা-র শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি যেখানে এমন থিওরীই দিয়েছেন যার নাম ‘মকারি‘ এবং আলোচনা করেছেন এর বিভিন্ন দিক নিয়েও, যে কিভাবে ‘কলোনাইজ্ড’ দেশের জনগণ কলোনাইজারদের অন্ধ অনুকরণের চেষ্টা করতে থাকে এটা জেনেও যে তারা কত অত্যাচারী, এবং তাদেরই রক্তমাংস নিংড়ে তারা শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। এবং সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয় একদিন, যখন কোনো প্রশংসাই জোটেনা সেই অন্ধ অনুকরণে, বরং তারা হারিয়ে ফেলে তাদের শিকড়, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে। সুতরাং এই সকল তত্ত্বের সাথেই আমরা বর্তমানের মিল পাই ভীষণ। শুধু সমাজ, চরিত্রগুলো বদলে গেছে। সেই 'মকারি'-র ফাঁদে পা দিয়ে আমরা যা দেখছি যা বুঝছি যা গুলে খাওয়ানো হচ্ছে তাই গিলছি, করতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি থেকে বিস্মৃত হয়ে অপরকে অন্ধ অনুকরণের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে নিজেদের শিকড়কে হারিয়ে ফেলে হয়ে উঠছি অস্থির। সেই 'কলোনাইজার' কিম্বা 'কলোনাইজড' শব্দগুলো এখন আর ব্যবহার হয়না সাধারণ সমাজে, কিন্তু তাদের ছায়াগুলো রয়ে গেছে, তাদের এখনো আমরা প্রভু বলে মেনে বসি। যেমন পশ্চিমবঙ্গে থেকেও বাংলা ঠিক করে লিখতে পড়তে না জানলেও কোনো প্রশ্ন ওঠেনা কিন্তু ইংলিশ ঠিক করে বলতে না পারলে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তা কি পোস্ট কলোনিয়ালিজমের ছায়া নয়? এর ফলে সেই ছাত্রটির মনে অস্থিরতা জন্ম নিলে তাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখব আমরা?

                                    এবার আরেকদিক থেকে বিষয়টি দেখা যাক, আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে নিম্নমেধার চর্চার বিকাশের নজরে — বর্তমান সময়ে কার্যত আমাদের ভারতবর্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সারা দুনিয়াব্যাপী যে রাজনৈতিক কদর্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, এক ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি, নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে কেচ্ছা, মারামারি, রাহাজানি প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে গোটা সমাজব্যবস্থার এক অস্থিরতা ফুটে উঠছে বলা যায়, যখন ইসরাইল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অশান্তি, লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি, হাজার হাজার শিশু ও মহিলাদের মৃত্যু, এইসব পরিস্থিতি যখন বর্তমান এবং এই যুদ্ধ মেটার কোনো পরিস্থিতিও সামনে দেখা যাচ্ছেনা তখন কি বলা যায় এটা সমস্ত শিশুমন বেড়ে ওঠার ও মনের সুস্থিরতা বজায় রাখার সুসময়? সেই যুদ্ধরত দেশগুলির অচলাবস্থা কেড়ে নিচ্ছে প্রতিটি জীবনের সুস্থিরতা, যেখানে জীবন মরণই একমাত্র ভবিতব্য সেখানে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা এই শিশু-তরুণ মনগুলির অস্থিরতাকে দেখব? কাদেরকে দায়ী করব এই ব্যবস্থার জন্য? শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের পরিণতি, প্রতিটি মৃত্যু দেখে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত দেশের কচি রঙিন মনগুলো কি আদৌ শান্তি পাবে? যুদ্ধ থামানো যাচ্ছেনা কেন এই প্রশ্ন হাতড়ে হাতড়ে উত্তর না পেয়ে তারা কি অস্থির হয়ে উঠবেন? একটা সমগ্র দেশের একের পর এক জেনারেশনকে এই যুদ্ধের ক্ষত বয়ে যেতে যেতে বারবার অস্থির হয়ে উঠতে হবে, কেন আমরা যুদ্ধ থামাতে ব্যর্থ এই প্রশ্ন মনে আসলেই বারবার মানসিক ভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠে অস্থির হয়ে উঠবে আমাদের সকলের মন।

                                         আসলে এই পর্যায়টিকে আমরা ব্যাখা করতে পোস্ট মডার্নিস্ট ও কনটেম্পরারি দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্য নেবো। আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি সেই সাদাত হাসান মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের কথা, যেখানে আমরা পাগলাগারদের কিছু পাগলদের কথা দেখতে পাই ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের সময়ে, অর্থাৎ তাদের ওপর এর কী প্রভাব পড়েছিল। আসলে মান্টো এখানে সেই সব পাগলদের কথা বলছেন, মূলত বিশেন সিং-এর। তার আজগুবি বিড়বিড় করে কথা বলা, গল্পের শেষে ভারত-পাকিস্তান বর্ডারের মাঝখানে ‘no man’s land’-এ গিয়ে শুয়ে পড়া এবং সে পাগলা গারদে ১৫বছর ধরে টানা দাঁড়িয়ে থাকার পর প্রথম শুয়েছিল ওই জায়গায়। অর্থাৎ দেশভাগের বিপরীতে দেশের ঐক্য ফুটিয়ে তোলেন গল্পকার কিন্তু আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে এক মানসিক অস্থিরতার সাথে এই গল্পের মিল পাই কীভাবে? পাই এইভাবে যে রাজনৈতিক চর্চায় স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্রমহ্রাসমান পরিসরের মাধ্যমে প্রতিটি ব্যক্তির মতপ্রকাশের পরিসর ও মাধ্যম কমতে কমতে সেই গল্পের বিশেন সিং-এর পর্যায় নিয়ে চলে গেছে। যেখানে আমরা দেখতে পারি আমাদের রাজ্যে আর.জি.কর. মেডিকেল কলেজে ভয়াবহ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রত্যেকের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর রাস্তায় রাত দখল থেকে বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদে নামা। কিন্তু এরপরেও একের পর এক এমন ঘটনা ঘটে যেতে দেখছি আমরা। নাগরিক হিসেবে প্রতিবাদ করলেই মিলছে লাঞ্ছনা, অপমান, হুমকি, হুঁশিয়ারি, কোথাও মারধর বা গ্রেফতারি। এইভাবে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার নামে আড়ালে এইভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ চলতে চলতে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে গোটা সমাজ। সেই মানিয়ে নিয়ে চলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে খেতে অধৈর্য্য অস্থির হয়ে উঠছে মানব মন। ছোটবেলা থেকেই শিশুদেরকেও শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই এক বুলি, তারাও হয়ে উঠছে অস্থির। এমন কি ডিকনস্ট্রাকশন থিওরী অনুযায়ীও কেউ যদি কোনো থিওরী কোনো ঘটনা কে প্রথমে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখা করার চেষ্টা করে তখন মিলছে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ, আর সোশ্যাল মিডিয়া সহযোগে হয়ে উঠছে তা অশোভনীয় ও অসহনীয়। যখন 'যুদ্ধ নয় শান্তি চাই' বলে স্লোগান দিলেও আক্রান্ত হতে হয়, যখন 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' চেয়ে স্লোগান দিলেও গ্রেফতার হয়ে যেতে হয়, ধর্ষণ খুনের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদীদের ওপর লাঠির আঘাত নেমে আসে, যখন শিক্ষক সমাজের ওপর নেমে আসে পুলিশের লাথি, শাসকের নখ দাঁতের ক্রমবর্ধমান হিংস্রতার অংশ রূপে, তখন সুস্থির থাকা সম্ভব নয়, আর সেটাই স্বাভাবিক, সময়টা যখন অস্থির, অস্বাভাবিক, তখন স্বাভাবিক মানসিক প্রবৃত্তি হিসেবেই মনে অস্থির হয়ে ওঠাটা স্বাভাবিক। বরং অস্থির না হয়ে উঠলে, চঞ্চল না হয়ে উঠলে বুঝতে হবে মানুষ তার অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে। আজ আমরা প্রত্যেকে বলতে সক্ষম আমরা কেউ বোবা হয়ে যাইনি, কিন্তু আমরা বলতে পারার ক্ষমতা থেকেও কতটা বলতে পারছি, আমরা যেটা পছন্দ করছিনা, সেই অপছন্দটা কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারছি? সেই বোঝাতে না পারার কিছু করতে না পারার অক্ষমতা থেকে জন্ম নিচ্ছে সহায়তা, এবং শিশু-তরুণ মনে এর প্রভাব পড়ছে সবথেকে বেশি কারণ তাদের মনে জেগে ওঠা প্রশ্ন গুলোর ন্যায়সঙ্গত ন্যায্য উত্তর তারা পাচ্ছেনা, সেই না পাওয়া উত্তর থেকে জন্ম নিচ্ছে অস্থিরতা ও হতাশা।

                                              কার্যত যেভাবে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ঘটেছে, ‘অ্যানিমাল‘, 'কবীর সিং’-এর মতন চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় হতে দেখছি, 'কেজিএফ', 'পুষ্পা'-র মতোন কার্যত অসামাজিক কাজ করে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিদের 'হিরো' বলে পুজো করতে শুরু করেছি, প্রেম, ভালবাসা, ঔদর্যতা, জ্ঞান, বুদ্ধি, নীতি, আদর্শের বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছি তখন বুঝতে হবে আমাদেরও কোথাও ভুল হয়ে যাচ্ছে। নজর রাখতে হবে সন্তানের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ওপর। অভিভাবক হিসেবে নিজেদের ভাষা নিজেদের ব্যবহারেও আনতে হবে পরিমিতি বোধ। সন্তানকেও প্রশ্ন করতে থাকতে হবে কেন সে 'কেজিএফ', 'পুষ্পা' দেখে আনন্দ লাভ করছে, কী বুঝছে সে? কেন সে অ্যান্টি-ফেমিনিস্ট, অ্যান্টি-এলজিবিটিকিউ হয়ে উঠছে? কেন সে আলফা মেল, সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠার পোস্ট ভাগ করে নিচ্ছে তার সোশ্যাল মিডিয়া তে, আসলে সব কিছুর জন্যই প্রয়োজন এক বুনিয়াদি শিক্ষার, বাবা-মার ফোন ব্যবহারের সম্পূর্ণ দিক না জানার সুযোগে সন্তান হয়ে উঠছে বেপরোয়া, সুতরাং প্রয়োজন প্রাথমিক স্তর থেকে বর্তমান দুনিয়ার অপরিহার্য বস্তু এই মুঠোফোন ব্যবহারের জন্য এক বুনিয়াদি শিক্ষার। আর যখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তা হয়ে উঠছে আরও ভয়ঙ্কর, সহজেই বিকৃত করে তোলা যাচ্ছে যেকোনো ছবি, যে কোনো ঘটনা, যে কোনো খবর। সুতরাং সত্যমিথ্যা যাচাই-এর প্রয়োজন অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর এই ডিজিটাল ট্র্যাপে প্রতারিত যাতে না হয়ে পড়ে শিশুরা, সেই দিকগুলোকেও খেয়াল রাখতে হবে অভিভাবকদের। নিজস্ব ক্রিয়েটিভ সত্ত্বার বিকাশের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সহজেই প্রম্পট দিয়ে গল্প, কবিতা, ছবি, এ্যাসাইনমেন্ট, হোম ওয়ার্ক তারা করে ফেলছে, ফলে নিজে থেকে চেষ্টা করার খিদে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, আর বহু ক্ষেত্রে চ্যাটবট হয়ে উঠছে তাদের বন্ধু, ফলে তারা সামাজিক মেলামেশা থেকেও পিছিয়ে পড়ছে। খেলাধুলা, গ্রুপ স্টাডি সবই হারিয়ে যেতে বসেছে, সেই জায়গায় জীবনে বাস্তবতায় পা রেখে চলতে গিয়ে হোঁচট খেলেই তারা খেই হারিয়ে ফেলছে, কার সাথে কথা বলবে, সময় কাটাবে, দুঃখ ভাগ করে শান্তি পাবে, আর উত্তর মিলছেনা, এছাড়াও রয়েছে 'ফোমো' হওয়ার ভয়, অর্থাৎ 'ফিয়ার অফ মিসিং আউট'। এটি কখন দেখা যায়? যখন সমাজ মাধ্যমে কোনো সিনেমা, ঘটনা খুব ভাইরাল হলো, অথচ আপনি সেই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না অথবা অনলাইন না থাকার কারণে জানতে পারলেন না, তখনই আপনার মনে সেই ফোমো কাজ করবে মনে হবে, 'আমি কি একটা মিস করে চলে যাচ্ছি, সবাই কথা বলছে অথচ আমি বলতে পারছিনা'। অথচ সেটা সাময়িক, কিছুদিন পরেই আবার নতুন কোনো ট্রেন্ড চলে আসবে, তখন আবার তাতে গা ভাসানোর পালা, এভাবেই মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে তারা । যখনই ট্রোলিং-এর শিকার হতে হয় তখন তারা চলে যাচ্ছে ডিপ্রেশনে। সুতরাং সন্তানের বেড়ে ওঠায় ও মানসিক বিকাশে এই যুগে যে এক বিশাল বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে স্মার্টফোন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে অভিভাবক দেরও শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে ও সন্তানের সাথে এই সকল বিষয়ে খোলামেলা আড্ডা দিতে হবে। নচেৎ, এই মানসিক বিকৃতি বাড়তে বাড়তে ক্রিমিনালিটির পথেও এগিয়ে যেতে পারে, কখনও তো সুইসাইডাল চিন্তাভাবনাকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে, আবার কখনো পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি করে দিতে পারে, তাই তার আগেই প্রাথমিকভাবে বাড়ির পরিবারের এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন এবং সমস্যা গুরুতর হলো অবিলম্বে মনোবিদদের কাছে কাউন্সেলিং করানো উচিত।

                                                    পরিশেষে এটুকুই বলতে হবে, মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমাদের সত্যিই যুদ্ধে নামতে হবে মনস্তাত্বিক পর্যায়ে। যুদ্ধ করতে হবে প্রতিটি অশ্লীল, নোংরা মানসিকতার বিরুদ্ধে, নয়তো এই রক্তবীজের বংশ ক্রমশ ডালপালা মেলে টুটি চেপে ধরবে আমাদের। তখন আর কিছু করার থাকবেনা। এখনই সময় এক বিকল্প ধারাভাষ্য ও মাধ্যম গড়ে তোলার, বই, সংবাদপত্রে পুনরায় ফিরে আসার, বলা যেতে পারে সেই ব্যাক টু বেসিকস-এর মতন। এই সমস্ত কিছু মেনে নিতে হচ্ছে আমাদের, সমস্ত যুদ্ধ, সমস্ত অনৈতিক কর্মকাণ্ড, সমস্ত বিকল্পকে হত্যা করা হচ্ছে প্রতিটা স্বপ্নের হত্যার মাধ্যমে, এই সবকিছুর মধ্যেও মানুষের বাঁচামরা চলছেই, অসম্ভবের মধ্যেও সম্ভবতা বেঁচে রয়েছে, বাংলা নাটকের প্রথম পোস্ট মডার্ন নাটক বলা হয় যাকে সেই ব্রাত্য বসু ‘অশালীন‘ নাটকের যেমন এক চরিত্র সুজনের বক্তব্য, "কারণ আমরা সকলেই এক ভয়ংকর অনিবার্যতায় নিঃসন্দেহে এক একটি মানুষের বাচ্চা বলে, হ্যাঁ মানুষের বাচ্চা বলে।" এখান থেকেই বোঝা যায় আমাদের কেন অত মেনে নেওয়া, কেন অত অস্বাভাবিকতার মধ্যে স্বাভাবিকতা খুঁজে নেওয়ার লড়াই। শেষে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সেই ‘ব্রেইন‘ নাটকের শেষ দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে যেখানে মূল দুই চরিত্র এক ভেঙে যাওয়া খেলনা ব্রেইনকে জুড়তে বারংবার ব্যর্থ চেষ্টায় মগ্ন। কিছুতেই তারা জুড়ে নিতে পারছেনা সমস্ত ব্রেইনের অংশগুলি, আমাদেরকেও আরেকবার চিনে নিতে হবে সেই সমস্ত অংশগুলি, আদেউ সব অংশ সঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা, আমরা সব ভেঙে যাওয়া অংশগুলি জুড়ে নিতে পারছি কিনা। আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ‘ব্যাক টু বেসিক্সে ‘। আবার রাঙিয়ে তুলতে হবে ধুসরতায় ঢেকে যাওয়া কচি মনের সেইসব রঙিন স্বপ্নগুলোকে, আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। শেষ করি কবি নবারুণের কবিতার লাইন ধার করে, "ইশতেহারে দেয়ালে স্টেন্সিলে,কবিতা এখনই লেখার সময় / নিজের রক্ত অশ্রু হাড় নিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে এখনই কবিতা লেখা যায়"।

Comments