সাজো-সাজাও এমন করে/ বুঝতে না’রি কেমন তুমি?
- বেদব্রত
রামকৃষ্ণ ছিল উদার আর আমরা নয়াউদার। আমরা এতটাই উদার যে আমাদের সবটুকু পণ্য - পাড়ার কাকুর দোকানের চায়ের রঙ থেকে গলির মোড়ের বিড়ালের সদ্য দুদিনের ছানাপোনা গুলোও। আমাদের আইডেন্টিটি হরদম বিক্রি হচ্ছে। পুঁজির আকিউমুলেশনেই শুধু আটকে নেই আইডেন্টিটির ইডিওলজিকাল রিপ্রোডাকশন এও বহাল তবিয়তে করছে। এই ইডিওলজিকাল রিপ্রোডাকশন ব্যাপারটা কীরকম? ধরা যাক তুমি এমন একটি বাড়িতে জন্মেছ যেখানে ছোট থেকেই ডাইনিং টেবিলে খাওয়া দাওয়া অভ্যেস, এবং তোমাকে ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া কে তোমার বাবা মা গুড ম্যানার বলে প্র্যাকটিস করিয়েছে। এবার হঠাৎ একদিন তুমি আর তোমার আরেক রিলেটিভ এর আলোচনায় সে হঠাৎ যদি বলে ওঠে মুসলমানরা তো খাটে খায়, বাবাগো কি নোংরা। তোমার মনে সহজেই ‘মুসলমানরা যে নোংরা’ এই স্টেটমেন্টটির প্রতি একসেপ্টেন্স তৈরি হল কারন তুমি ঐ ‘গুড ম্যানারে’ যে অভ্যস্ত। তার মানে তোমার আশেপাশের মানুষদের কথাবার্তা আচরণ তোমার মধ্যে একভাবে শেপ দিল যে কোনটা নোংরা এবং তোমার সঙ্গে খাটে বা মেঝেতে বসে যারা খায় সেইসব নোংরা লোকেদের সঙ্গে এক হায়ারার্কি প্রতিষ্ঠিত হল তোমার মস্তিষ্কে এবং এক তুচ্ছতার নজর - বৈরী সম্বন্ধ। কী করে আইডেন্টিটি সম্পর্কে ধারণা শেপড হয় সেসম্পর্কে আলোচনা পরে করব।
আরও একটা কথা বললাম, অ্যাকুমুলেশন। এটিও দুভাবে হয়, একটা হল প্রিমিটিভ আরেকটা হলো অ্যাকুমুলেশন বাই ডিসপোজিসন। এইগুলো কী? কলোনিয়াল ভারতে রেলপথ নির্মাণের জন্য আদিবাসীদের দিয়ে বেগার খাটানো এবং তাদের বাসস্থানের কাঠ লাইন পাততে অবাধে ব্যবহার এইটি হল প্রিমিটিভ অ্যাকুমুলেশন। আবার ধরা যাক একটা কোম্পানি এরকম কোনো পলিসি আনলো, যাতে বলা হল যে কোনো পদই পার্মানেন্ট আর থাকবে না, এবং এর নেক্সট দিনই একটা কর্মচারীকে ছাঁটাই করে ফেললো এবং সেই কর্মচারীটি ততক্ষনাৎ দরকারেই আরেকটা জায়গায় কম মাইনে হলেও যোগ দেবে। এইটার ফলে আর শুধুমাত্র বিযুক্ত শ্রম থেকে সারপ্লাস জেনারেট করাতে থেমে না থেকে নন ক্যাপিটালিস্ট যে অংশ সেগুলো থেকেও একটা কন্টিনিউয়াস অ্যাকুমুলেশন জারি রাখা হল। আইডেন্টিটির ক্ষেত্রে সেটি কীরকম তা পরে বলছি।
এখন আসা যাক, ডেভিড হার্ভের কথায়, একজন দাদু মার্কা লোক সাদা সাদা চুল। তার একটা বই আছে ‘a brief history of Neoliberalism’ - সেখানে তিনি কইছেন যে,‘..the key to the process of spreading neoliberalism into everyday life involves recasting the individual into an entrepreneur of the self.’ এবং, ‘The individual as entrepreneur of the self … conceived in Human Capital Theory as a unit of economic potential, to be developed and deployed to maximise economic returns.’ গদগদ বাংলায় যদি একে ব্যাখ্যা করতে হয় তাহলে আমাকে ফিরে যেতে হয় সেই সব ইংল্যান্ডের কারখানায় যেখানে শ্রমিকরা শুধুমাত্র নিজের শ্রমশক্তি কেই এক্সচেঞ্জ করার কথা ভাবতে পারত। এখন ঠিক তেমন না। তাহলে কেমন? তুমি একটি নিওলিবেরাল সেলফ, যে সবসময় চাইছে নিজেরে এক ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিপন্ন করে তুলতে, যার জন্যে সে শিখছে বিভিন্ন ধরনের স্কিল, কিন্তু তাতে অ্যাকচুয়ালি সে মার্কেটে ভ্যালিডিটি পাচ্ছে বিভিন্ন স্তরে, মানে আসলে নিজেই পণ্য হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় শেখানো হয় কর্পোরেট স্কিল, ম্যানেজমেন্ট স্কিল, কামিউনিকেটিভ ইংলিশ এবং স্কিল ডেভেলপমেন্টের নানা কোর্স। বিভিন্ন কোম্পানি যারা এগুলো শেখায় তারা তোমারে কয় তুমি হলে হিউম্যান ক্যাপিটাল, এবং তুমি এই ক্যাপিটাল তোমার পিছনেই খরচা করো, নিজের স্কিল ডেভলপ করে নিজেকে entrepreneur হিসেবে গড়ে তুলতে কিন্তু তুমি সেই স্কিল গুলো শেখার মাধ্যমে মার্কেটে নিজেকে পণ্য হিসেবে আরও প্রতিষ্ঠিত করো অর্থাৎ সেই হিউম্যান ক্যাপিটাল তুমি খরচ করো নিজের কোমোডিফিকেশনে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তোমার আইডেন্টিটি রিশেপ ও অ্যাকুমুলেটেড হল। এবার এই যে entrepreneur সেল্ফ আইডেনটিটি যদি এদের মধ্যে বেশ কিছু এই সেল্ফ নিয়ে সত্যি সত্যি পুঁজির পিঠে চড়ে বসে, তাহলে তো পুঁজিবাদীদের নিজেদের স্বার্থে আঘাত। বাস্তবে এই entrepreneur সেল্ফ গুলো আদৌ পুঁজিপতি হয়ে উঠতে পারে না, কেন! কারণ এই সেল্ফ এর মূল উদ্দেশ্য হলো বড়লোকদের মতো প্রাইভেট সম্পদ কনসাম্পশন। কিন্তু কাকা পুঁজিবাদ যে ক্যাপিটালের ইন্টারেস্ট চালায়, অর্থাৎ কনসম্পশন নয় পুঁজির বহমানতা ঘটানো জরুরি। কিন্তু এই যে, বড়লোকদের সম্পদ, লাইফস্টাইল একদিন নিজের হবে এই স্বপ্ন, এই যে entrepreneur সেল্ফ এই আইডেন্টিটাকে অপটিমিজম এর মোড়কে মুড়ে রাখে, ফলে আইডেন্টিটাও টিকে থাকে ও আক্যুমুলেটেড হয়।
ফুকো বলে আরো একজন ছিল ফরাসি লোক সে আবার কয়েছে, ‘The conduct of conduct is Governmentality.’ টার্ম টা শুনেই কানে বাঁধছে দুটো শব্দ একটা হলো গভর্নমেন্ট আরেকটা হলো মেন্টালিটি। এই খটমট শব্দটা দিয়ে কী বোঝায়? ধরা যাক কোনো একটি স্ট্রাকচার, ধরা যাক সেটি একটি স্কুল। স্কুলের মাস্টার একটি ক্লাসে এসে একটা ছেলেকে কেল্টে সম্বোধন (গায়ের রং কালো বলে) করে জিজ্ঞেস করল হোমওয়ার্কের কথা। ছেলেটি বলল সে পারেনি হোমওয়ার্ক এবং তারপর সেই মাস্টার তাকে মারল। বাকী স্টুডেন্টরা চুপ। মাষ্টারটি স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলে ছাত্রদের তুলনায় একটি পাওয়ার হায়ারার্কিতে প্রতিষ্ঠিত। ফলত সে নিজের পাওয়ার প্রয়োগের দ্বারা প্রথমত একটি রেসিস্ট কমেন্ট প্রয়োগ করতে পারছে এবং দ্বিতীয়ত কোনো কাজ পানিশেবল কিনা এবং পানিশমেন্ট নির্বাচন ও প্রয়োগ করছে, এবং তা দেখে বাকি ছাত্ররা চুপ। কেন? কারণ হল লজিক অফ পাওয়ার যা নর্ম হিসেবে অপ্রেসডদের কাছে এক্সেপ্টেড হয়েছে, প্রথমটা মজা হিসেবে, দ্বিতীয়টা শৃঙ্খলা হিসেবে। এবং সেই মাস্টার এই ঘটনা আরো হাজার বার করলেও একটা ছাত্রও এর বিরুদ্ধে বলবে না। স্ট্রাকচার অটুট থাকবে। অর্থাৎ পাওয়ার ধরে রাখতে গেলে পাওয়ারে আসীন হওয়ার জন্যে জাস্টিফিকেশন এবং তা স্ট্রাকচার এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া প্রয়োজন, এবং ইন্ডিভিজুয়াল সাবজেক্টের সেই জাস্টিফিকেশন একসেপ্ট করা, এবং পাওয়ার হায়ারার্কি প্র্যাকটিস করা প্রয়োজন। এইটিরেই কয় গভার্নমেন্টালিটি।
যেকোনো সাধারণ শিক্ষাক্ষেত্র এখন শিক্ষার স্বরূপ হিসেবে আমাদের কাছে এনে রাখে এম্প্লয়বিলিটি, সেটিই আমাদের কাছে শিক্ষার স্বরূপ হিসেবে গৃহীত ও হয়। এই যে শিক্ষানীতি NEP 2020 এর যে গঠন কাঠামো, অর্থাৎ তুমি একটি 4 বছরের গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে 1 বছরও কন্টিনিউ করতে পারো এবং তার ভিত্তিতে তুমি একটি সার্টিফিকেটও পাবে এভাবে, যে যতদিন কন্টিনিউ করবে প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা সার্টিফিকেট এর মাধ্যমে যেমন সস্তা শ্রম এবং বিভিন্ন স্তরের শ্রমকে মার্কেটেবেল করা যাচ্ছে আবার একদিকে ছাত্রের মনে entrepreneur সেলফ গড়ে তুলছে এবং তারা সেই entrepreneur সেলফ এর দিকে প্রাথমিক ভাবে বিরাট আশাবাদী। এই অপটিমিসম অ্যাস এ নর্ম অ্যাক্ট করে, এখানে ছাত্রাবস্থায় NEP এর যে রাষ্ট্রীয় দমনমূলক চরিত্র তার প্রতি ক্ষোভ জন্মানো থেকে বাধা দেয় এবং শিক্ষার স্বরূপ হিসেবে এমপ্লয়বিলিটি কে আরো ভালোভাবে সবার মননে রিপ্রডিউস করায়। কিংবা ধরা যাক করোনার সময়ে হাইজিন মেইনটেন কে একভাবে এক স্তরের মানুষদের কাছে মরাল কর্তব্য হিসেবে তুলে ধরা, এও দেখেছি সেসময় বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত পা ধোয়ার পরও স্যানিটাইস করেছে কিনা তা নিয়ে অশান্তি। অর্থাৎ মরালিটি হাইজিন মেইনটেইনকে একটি সেল্ফ রেসপনসিবিলিটিতে পরিণত করা, ফলে হাইজিন মেইনটেইন মুখ্য হয়ে ওঠার কারণে ইন্ডিয়ান হেল্থ সিস্টেম এর দুরবস্থা কিংবা ভ্যাকসিন দুর্নীতি এসব হয়ে গেলো গৌণ। অর্থাৎ আইডেন্টিটি যখন ইডিওলজিক্যালি রিপ্রোডিউস হয় তার মাধ্যমে সেটি কালেকটিভনেস হারায় ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে - ফলত তার কাছে সমস্যা হিসেবে কেবল তখন ধরা দেয় ব্যক্তিগত সমস্যা, সমষ্টির মধ্যে যে সেও বিদ্যমান সেটাই সে মানতে চায় না। ফলে খুব সহজেই শোষিত হতে হয়।
ধরা যেতে পারে আধার কার্ড আইডেন্টিফিকেশন এর কথা। সরকার আর চোখ ফুলিয়ে বলছে না, মানো নয়তো মরো। তার বদলে তারা বলল যে নিজেরে ভেরিফাই করে প্রুভ করে সিস্টেমের সাথে অ্যালাইন হও। তোমাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে যে নিজের আইডেন্টিটি ভেরিফাই করে এলিজিবিলিটি প্রমাণের দায়িত্ব তোমার নিজের, আর ঠিক এইভাবেই তুমি নিজের ডিজিটাল আইডেন্টিটির দ্বারা কন্ট্রোলড হয়ে স্টেট এর কাছে নিজের হাতের ছাপ থেকে ব্যাংকে জমানো পুঁজি, তোমার জেন্ডার থেকে তোমার গায়ের রং, সবকিছুর ডেটা প্রোভাইড করছ - স্টেট এর কাছে আরও বেশি ভাবে স্বচ্ছ ও ট্রাকেবল করে তুলছ নিজেকে। এবার ধরা যাক তুমি ব্যাংকে গেছো। তোমার আধার কার্ডের সঙ্গে ব্যাংক এর লিঙ্ক কেটে গেছে বলে তুমি তোমার হকের পেনশন পাচ্ছ না, এক্ষেত্রে তুমি তোমার হকের টাকার দাবিতে আর চেঁচামেচি করতে পারছ না, বরং এই যে নিজের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তোমার এলিজিবলিটি ক্রাইসিস হিসেবে প্রতিপন্ন হচ্ছে। মানে পেনশন সুরক্ষিত করা এবং বণ্টন যা ছিল স্টেট এর ডিউটি এই ডিজিটাল আইডেন্টিটিকরণ এর মাধ্যমে তা তোমার ইন্ডিভিজুয়াল কর্তব্য তে পরিণত হলো।এবং তুমি অজান্তেই আরও একবার লজিক অফ পাওয়ার মেনে নিয়ে নিজের একটি ডিজিটাল আইডেনটিটি ক্রিয়েট করে এলিজিবল থাকার জন্যে সর্বদা নিজের পার্সোনাল ডেটা কে আপডেট এর মাধ্যমে সরকারের কাছে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে একইসঙ্গে বিচ্ছিন্ন ও শোষিত হলে।
ধরা যাক তোমার সামনে অনেকে খাবার। তুমি কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবে ভেবে কিনারা পাচ্ছ না। এবার ধরা যাক তুমি আঙুল ছোঁয়ালেই আগের জনের প্রোফাইল হুস হয়ে নতুন হাজির হচ্ছে - তলায় পয়েন্ট করে লেখা পছন্দ অপছন্দ(বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপ, ম্যাত্রিমোনিয়াল সাইট)। এইযে এত্ত অপশন, একটা ছেড়ে আরেকটা চয়েজ এর স্বাধীনতা পাচ্ছ। কিন্তু আদৌ কি তা? ব্যারি শোয়ার্টজ একটি বই লেখেন, ‘paradox of choice', এই যে তোমার সামনে অসংখ্য চয়েস, তুমি কোনটা বাছবে, কেন বাছবে, কোনোটা বেছে নিলে তারপর মনে হবে না তো যে চয়েসটা ঠিক হলো না! এই যে ইনফাইনাইট চয়েস যা তোমার মস্তিষ্কে একটি পার্সোনাল কাস্টোমাইজেশনের ধারণাকে বয়ে আনছে। তুমি যা কিছুই করছো, কিংবা তোমার যা কিছু তা তোমারই চয়েজ এটি মানতে বাধ্য হচ্ছ। একটা কনস্ট্যান্ট ডিস্যাটিস্ফ্যাকশন তৈরি হচ্ছে। নিজেরে স্যাটিসফাই করতে সেই অসংখ্য অপশন এর মধ্যে থেকে আপগ্রেডেবেল (ব্র্যান্ডিং প্রভাবিত ফ্যান্টাসি) অপশন কনজিউম করেছি। ক্রমাগত নিজের চয়েস নিয়ে অখুশি থাকা, ফোমোতে (Fear of missing out) থেকে (এগুলারে একলগে কয় Grass is Greener syndrome) এবং অখুশি মেটাতে আবার নতুন কিছু কনজিউম করার মধ্য দিয়ে, এই যে র্যাণ্ডম আইডেনটিটি শিফট যা মুনাফার হারকে ম্যাক্সিমাইজ করছে। এই যে আমাদের চারপাশে এত্ত সুপার মার্কেটের রমরমা, তাতে হরেক প্যাকেট এবং সুপারমার্কেট, এর প্রতি এই যে লোকের ফ্যান্টাসি, এই ফ্যান্টাসি তৈরি হল কীভাবে, এবং এই ফ্যান্টাসি শুধু মাত্র মধ্যবিত্ত ও ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, গরিবদের মাথাতেও ঢুকে গেছে। ফ্যান্টাসির আকার গুলো আলাদা আলাদা। ধনীরা যায় Zara, গরিবরা Fashion Bazaar। একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। কোনো বড়লোক, তার মাথার মধ্যে ঘোরে নিজেকে অ্যাস্থেটিক্যালি সাজিয়ে তুলতে হবে, ক্লাস স্ট্যাটাস মেইনটেইন রাখতে হবে - এবং এই অ্যাস্থেটিকনেস এর হার ও মান বাড়ানোর জন্যে সময় ব্যয় করে চয়েজ করে নিয়ে যায় জিনিস, আবার সেই জিনিস নিয়ে অখুশি হলে আবার আসে, নিয়ে যায় আরো একটা জিনিস যার ব্যবহার কিন্তু একই। অর্থাৎ এই যে দুটো জিনিস যাদের ইউজ ভ্যালু সেম সেরকম দুটো জিনিস একজন ইউজার দ্বারাই কনজিউম করার মধ্যবর্তী যে সময়ের গ্যাপ, সেটাকে ছোট করে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং এর সঙ্গে ইনফাইনাইট চয়েস এর মধ্যে থেকে চয়েস করার জন্যে যে ব্যাপক সময় আমরা লাগাই, এবং তার ফলে আমাদের মনের মধ্যে যে আরো বেশি করে গেঁথে যায় যে নিজের চয়েসের জন্যে আমিই একমাত্র দায়ী, তার ফলে তৈরি হওয়া যে ডিসস্যাটিসফেকশন, সেটিই এই পরপর একই জিনিস কনজিউমের মধ্যবর্তী সময় কমিয়ে অনার জন্যে দায়ী। গরীব যারা তাদের তো বার বার কনজিউম করার ক্ষমতা নেই, কিন্তু যদি দুবারও একটি একই ইউজ ভ্যালু যুক্ত জিনিস (ধরা যাক জামা) কেনে, তাও কিনতে যায় মলে। কারণ সুপারমার্কেট কর্তৃক প্রচার, ভুয়ো অফার যা তাদের মনে এরকম ধারণার জন্ম দেয় যে এক কি দুবার একটা জামা কিনবো, যদি চয়েস অপসন একটু বেশি থাকে তাহলে মন্দ কি! এবং এইভাবে কিছুদিন কনজিউম করবার পর ক্লাস এলিভেশন কেও একভাবে ফ্যান্তাসাইজ করা শুরু করে। আর এর ফলে হয় দুটো জিনিস। এক, আগে তারা কিনতো লোকাল মার্কেট থেকে, এখন তারা যাচ্ছে মলে, ফলত ওই মলটি যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অধীনে তার ঘরে যাচ্ছে লাভের গুড় - মুনাফার কেন্দ্রিভবন। আবার যেহুতু লোকাল মার্কেট এর কাস্টমাররা শিফ্ট হয়ে গেলো এরফলে লোকাল দোকানদার রা আর ব্যবসাটা চালাতে পারল না। কিন্তু বেঁচে থাকতে গেলে পয়সার দরকার, তাই তারাও যোগ দিলো এইসব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির দোকানগুলোয় কর্মচারী হিসেবে ফলে তাদের শ্রমিকীকরণ হল (এটিও অ্যাকামুলেশন বাই ডিসপোসিসন) এবং ওদের বিযুক্ত শ্রম থেকে সারপ্লাস জেনারেট শুরু হল, ফলত মুনাফা আরেকধাপ কেন্দ্রীভূত হল।
ডেটিং অ্যাপ গুলো নিয়ে আগের প্যারার শুরুতেই শুরু করেছিলাম-আরেকটু বলি। এইসমস্ত অ্যাপে তুমি শুধু কনজিউমারই নও, তুমি পণ্যও। তোমার হাইট, জব, পড়াশুনা, মিউজিক টেস্ট সবই যেন অ্যাড- তোমার শরীর ব্র্যান্ড। সেই ব্র্যান্ড এর অ্যাড ভিজুয়ালিটি দেখে মেলে লাইক ফলো ম্যাচ, অর্থাৎ এগুলো দ্বারা কোয়েন্টিফাই হচ্ছে ডেজায়ার্যাবিলিটি। এইসব অ্যাপগুলো ভালোবাসা বেচে না ভালোবাসার চাহিদা (promise of love) টা কে বেচে। ভালোবাসা এক্ষেত্রে শ্রমে পরিণত হয় যা অবিরত শোষিত হয়। এবং এই অ্যাপের স্ট্রাকচারে যে অবিরাম চয়েস অপশন, অবিরাম স্ক্রোলিং তা একভাবে never-fulfilled desire কে এনসিউর করে যা একদিক দিয়ে স্ক্রোলিং করার সময়কে দীর্ঘায়িত করে, ফলত সময় একটি পণ্যের রূপ নেয়(প্লাটফর্ম ক্যাপিটালিজমের একটি অন্যতম পণ্য হল সময়)। আবার এইসব অ্যাপে, ফাস্টার ম্যাচেসের প্রিমিয়াম ফিচার থাকে। অর্থাৎ তোমার ভিতরের অস্থিরতাকে অনেকগুলো স্ক্রলিং এবং ফেলিওরের মধ্যে দিয়ে বাড়িয়ে তুলে কম সময়ে তোমার ডেটা পয়েন্টের সঙ্গে প্রায় মিলওলা আরেকজন কে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় অ্যালগো, তার জন্যে চায় সাবস্ক্রিপশনের ছুতোয় আরও পয়সা। এইভাবেও সময় কে বেচে। এবার আসা যাক প্রোফাইল মেকিং এর কথায়, গোটা প্রোফাইলটাই যেন প্যাকেজিং যেখানে বুলেটেড পয়েন্টস - জব টাইটেল ও ইউনিভার্সিটি নেম যেন ভ্যালু সিগন্যাল আর এক দুলাইনের চটকদার বায়ো যেন ব্র্যান্ড ট্যাগলাইন। ‘Cute but psycho’',‘emotionally damaged”,‘trauma-informed’', ‘Too anxious for dating but here anyway’', ‘Recovering softboi’ এইসব বায়ো তে ভরে ওঠে ডেটিং সাইট গুলো। তুমি তোমার ইমোশনকে কানেক্ট করাচ্ছ আইডেন্টিটির সঙ্গে এবং মিডিয়ায় সেগুলো ইউজ হচ্ছে ব্র্যান্ডিং স্ট্র্যাটেজির ফর্ম হিসেবে। ইমোশন গুলো যেন ক্লিকবেট - একধরনের রিসোর্স। অর্থাৎ কিনা তোমার প্রোফাইল (ধরে নিয়েছি পণ্য এর প্যাকেট হিসেব), সেই প্যাকেট অ্যালগরিদম দ্বারা চিহ্নিত হবে এবং ছড়িয়ে পড়ে আরো চারটে লাইক বাড়াবে, অর্থাৎ নিজেকে ম্যাচ করানোর জন্যে (মার্কেটেবিলিটি) আমরা অ্যাস্থেটিক লেবার দিই। প্রতিটা সোয়াইপ যেন এক একটা ইমোশনাল গ্যাম্বেল। অর্থাৎ কিনা তুমি একবার সোয়াইপ করলে, ম্যাচ খেল। আবার সোয়াইপ করলে, ম্যাচ খেল। তারপর সোয়াইপ করলে ম্যাচ খেল না, তার মানে এই যে ম্যাচ, যা তোমার ইমোশনটাকে ভ্যালিডিটি দিচ্ছে তা একভাবে তোমার প্রত্যাশাকে বাজি রেখেই তোমাকে দিয়ে জুয়া খেলাচ্ছে এবং তোমাকে আরেকবার সোয়াইপ করানোর জেদ চাপাচ্ছে এবং তোমাকে অ্যাপটিতে আবদ্ধ রাখছে। তোমার ইমোশন মনিটাইজড হচ্ছে এবং বায়োর মাধ্যমে প্যাক হয়ে মার্কেটে অ্যাপিলিং হয়ে উঠছে, ফলে ইমোশনও হয়ে উঠছে পণ্য, এককথায় যারে কয় ইমোডিটি।
“In a society of consumers, individuals are judged not by their birth, character or integrity, but by the capacity to make the ‘right’ choices, to be attractive, visible, and mobile.” - বাওম্যান কয়েছিল। একটা টার্ম ও বলেছিল-’লিক্যুইড মডার্নিটি’। তোমার আইডেনটিটি চুজ করার ফ্রিডম ক্রমশ সেটাকে আপডেটেড ও জাস্টিফাইড রাখার চাপ দিচ্ছে। ধরা যাক তুমি কবিতা ভালবাসো। একদিন একটা কবিতা পোস্ট করলে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিছু লাইক আসলো - প্রাথমিক ভাবে খুবই কম। এবার তোমার মাথায় সর্বদা ঘুরবে আমি তো কবিতা ভালবাসি কিন্তু এত কম লাইক কেন? (ইমপোস্টার সিন্ড্রোম)। অর্থাৎ তুমি নিজের অজান্তেই কখন যেন কোনো কিছুর প্রতি তোমার ফিলিং ইমোশন যা তোমার আইডেন্টিটির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, কতখানি তা মাপার বাটখারা হিসেবে বেছে নিচ্ছ লাইককে, ভিউজকে। এবং ভিউজ বাড়ানোর দায়ে মেপে বুঝে কনটেন্ট প্রোভাইড করছ, আর এর ফলে তোমার আইডেনটিটি এক্সক্লুসিভলি জেন্ট্রিফাইড হয়ে গেলো। এই যে বারংবার নিজেকে আপডেট করার দায় নিয়ে রেগুলার পারফরমেটিভ থাকা, এই যে অস্থায়িত্ব, কোথাও এসে দাঁড়ানোর জন্য অবিরাম পরিবর্তন ও দৌড়, এই অবিরাম চেঞ্জিং ফ্লোয়ের জন্যে বলেছে লিক্যুইড। যত বেশী অস্থিরতা তত বেশি জাস্টিফায়িং করে তোলার দায় অর্থাৎ তত নিজেকে প্যাকেজিং করে তোলা এবং যথাক্রমে ভ্যালু বাড়ানোর দায়।
এতক্ষণ প্রায় পুরোটাই বললাম কীভাবে স্টেট এমন পদ্ধতি নেয় যাতে আমরা নিজেদের আইডেন্টিটিকে নিজেদের হাতেই সাজিয়ে গুজিয়ে বেচে দিই। সেগুলোকে একভাবে থিওরাইজ করেছেন লোকজন, তাঁদের থিওরির উদাহরণভিত্তিক আলোচনা।
এবার একটু আসি ফেমিনিজম এবং সঙ্গে দাঁড়িয়ে কুইর ট্রান্স হোমোসেক্স্যুয়াল পলিটিক্স এর ভাষ্যে সমস্যা গুলিতে যা আজকের আইডেনটিটি পলিটিক্স প্র্যকটিস কে ক্লাস স্ট্রাগল থেকে আড়াল করে রাখে।
যেই মূল সমস্যার কথা বলতেই হয়, তা হলো empowerment। যেটা স্ট্রাগল এর মাধ্যমে হতে পারে সেই এম্পাওয়ারমেন্ট কে এখন ভিসিবিলিটির মাধ্যমে প্রদর্শন করে পণ্য করা হয়েছে। নব্যউদারনীতি নারীবাদকে বলেছে: “তোমাকে জিততে হবে, নিজের যোগ্যতায়”। নারীবাদ এখন হয়ে গেছে নিজেকে ব্র্যান্ড করার উপায় (যেমন: #GirlBoss সংস্কৃতি)। ফলে নারীবাদ রাজনৈতিক আন্দোলন না হয়ে হয়ে গেছে ব্যক্তিগত আত্মোন্নয়নের হাতিয়ার।যেমন নারী CEO হওয়াকে নারীবাদী বিজয় হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু এই CEO যদি হাজার শ্রমিক নারীকে কম বেতনে কাজ করান, সেটা সমস্যা না বলেই মনে করা হয়। নতুন ভাষ্যে বলা হয় যে “নারীদের যদি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস থাকে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, এবং কষ্ট করে, তাহলে সব বাধা পার করা সম্ভব।” এর দ্বারা আসলে নারীদের যত সমস্যা তার দায় একভাবে তাদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হয়। আবার পোস্টফেমিনিস্ট সংস্কৃতি কয় "নারীরা এখন স্বাধীন—তারা নিজের পোশাক পছন্দ করে, যৌনতা উপভোগ করে, কাজ করে। তাই নারীবাদের দরকার আর নেই।” এগুলো আসলে ভোগবাদের এক ব্র্যান্ডিং স্ট্র্যাটেজি। Dove এর Real Beauty Campaign এ বলা হয়: “সব নারীই সুন্দর, নিজেকে ভালোবাসো।”বাস্তবে এটি এমন একটি সৌন্দর্যপ্রচারণা যেখানে "body positivity" নারীবাদের নামে বিক্রি হয়। কিন্তু ব্র্যান্ডটি একইসাথে বাজারে ফেসওয়াশ, ফেয়ারনেস ক্রীম, ফ্যাট রিডাকশন প্রোডাক্টও বিক্রি করে, যা আবার সেই ‘সুন্দর’ নারীত্বের সাংস্কৃতিক চাপ পুনরুৎপাদন করে। Tanishq প্রতিবার ৮ মার্চে নারী দিবসে Women’s Day Campaigns এ নারীদের ‘অভিনব ও সাহসী’ হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু এই ব্র্যান্ডই নারীদের বিয়ের গয়না, বউমার স্টাইল, বাচ্চার জন্মদিনের উপহার হিসেবে সোনার গয়না বিক্রি করে।অর্থাৎ, নারীর সেল্ফ-হুড বা এজেন্সি প্রচার করলেও, নারীর সামাজিক ভূমিকা হিসেবে স্ত্রীর, মায়ের, পুত্রবধূর কাঠামো বজায় রাখে। বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও: এ ধরনের প্রকল্পগুলি নারী শিক্ষা ও সুরক্ষার কথা বলে, কিন্তু একইসাথে কন্যা সন্তানকে “জাতীয় সম্পদ” হিসেবে কনট্রোল করার যুক্তি দেয়। এটি empowerment না হয়ে হয়ে ওঠে “population governance”। প্রান্তিক লিঙ্গের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এক। অনেক জায়গাতেই সেম সেক্স ম্যারেজ আইন পাস থাকলেও তার ইমপ্লিমেন্টেশন কিছুই নেই। এছাড়াও প্রাইড মান্থেই কেবল বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা রঙ বেরঙের জিনিস বের করে মার্কেটাইস করে পিঙ্কওয়াশ করে, ব্যাস ওই অবধিই।
আজকের দিনে পরিচয় এক প্রকার মুনাফা অর্জনের স্থান হয়ে উঠেছে। তার বাজারিকরণ কেবল প্রতীকী নয়, বরং কাঠামোগত — পুঁজির নতুন চক্র তৈরি করে এবং প্রকৃত বৈষম্য ঢেকে রাখে। তাও অনেক আন্দোলন ও বিকল্প চর্চা আজো বাজারবিরোধী পরিচয় রচনা করে। “No Pride for Some of Us” বা “Dalit Feminist Network”, ভারতের মতো দেশে, বাজারিকরণের বাইরে গিয়ে বর্ণ, লিঙ্গ ও শ্রেণিভিত্তিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। এরা inclusion নয়, পরিবর্তনের কথা বলে। পরিচয় হতে পারে সংগ্রামের ক্ষেত্র — যদি আমরা এটিকে পণ্য না করে প্রতিরোধ ও সংহতির ভাষা বানাতে পারি। পরিচয়কে বাজারের বাইরে নিয়ে এসে শ্রেণি, লিঙ্গ, জাত, ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে যুক্ত করাটাই আজকের চ্যালেঞ্জ। — যাতে কেবল স্বীকৃতি নয়, বাস্তব সম্পদের বণ্টন নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়।
Comments
Post a Comment