দৈনন্দিন জীবন ও সে বিষয়ে কথোপকথন
- রূপকথা, XII
সেক্স এডুকেশনের কী প্রয়োজনীয়তা এই নিয়ে নানা রকম থিওরি, গুরু গম্ভীর কথা আমরা শুনেই থাকি। লিঙ্গ নির্বিশেষে সমাজে সমান অবস্থান পাওয়ার যে লড়াই, বলা ভাল মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে স্থান করে নেওয়ার যে লড়াই, তার জন্যেই প্রয়োজন যৌন শিক্ষা। মনে হতে পারে, জীবনবিজ্ঞানের কিছু সংজ্ঞার সাথে সমাজের, সামাজিক অবস্থানের কি যোগাযোগ থাকতে পারে? আসলে শিক্ষা ব্যাপারটাই গুরুত্বপূর্ণ। মানব জীবনের নানা প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটা যৌনতা। তার সাথে জড়িত বয়েসের সাথে সাথে শরীরে নানা বদল, ঋতুস্রাব, মানসিক বদলগুলোও, হরমোন, ইত্যাদি। সেগুলো বিষয়ে অজ্ঞতা থাকলে সমাজে নেতিবাচক ছাপ পড়বে তো বটেই।
আমি নিজে যেহেতু একজন মেয়ে, আমি একজন মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, খুব কাছে যে পরিস্থিতি দেখি, তাই লিখছি। ছেলেদের বিষয়ে লেখার মত আলাপচারিতা বা জ্ঞান কোনোটাই আমার নেই, তাই লিখতে পারলাম না।
আমরা যদি খুব কাছের চারদিক ধরে দেখি, তাহলেই ছোট ছোট জিনিস চিহ্নিত করতে পারব। মোটামুটি শিক্ষিত পরিবেশে বড় হয়েছি আমি, বন্ধু বান্ধবদের সবারই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যেটুকু থাকা দরকার, তা আছে। কিন্তু কথার তোড়ে হঠাতই তাও বেরিয়ে এসেছে, পুজো দিতে পারব না, কারণ আমার পিরিয়ডস চলছে। “শরীর খারাপ” থেকে কথাটা পিরিয়ডে উত্তীর্ণ হয়েছে বটে, কিন্তু বহু বছর ধরে অভ্যেস করা ব্যাবস্থাগুলো বদলায়নি। হতে পারে খুব একটা ভেবেই দেখেনি কেউ। অপবিত্র মনে হওয়ার যে ব্যাপারটা, সেটাও রয়ে গেছে কিন্তু। তবে এইটাই ভাল ব্যাপার যে রান্নাঘরে ঢোকা যাবে না, ঠিকঠাক বিছানায় শোয়া যাবে না ইত্যাদি নানাবিধ কুসংস্কার একটু একটু করে কাটছে মানুষের। কিছু দেশে, কিছু কালচারে ঋতুস্রাবকে এত নিচু করে না দেখালেও, অধিকাংশ সংস্কৃতিতেই এখনো অশুচি হিসেবে দেখা হয়।
পিরিয়ডস প্রোডাক্ট মেয়েদের জন্য আরেক সমস্যা। আমরা আমাদের পরিচিত সার্কেলে হয়ত দেখে থাকব প্যাডের ব্যবহার। কিন্তু প্যাডের এমনই দাম, যে বহু সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না প্রতি মাসে তা কেনা। তাই মেন্সট্রুয়াল প্রোডাক্ট ফ্রি করার লড়াই বজায় থাকছেই। নুন্যতম হাইজিন সবার অধিকার। আমরা, তুলনামূলক ভাবে অর্থনৈতিক ভাবে ভাল অবস্থায় যারা, তারা দেখে থাকি অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা। মেয়েদের বাথরুম নেই যেমন অনেক জায়গায়, তেমনি প্রয়োজন অনুযায়ী ডাস্টবিন নেই, কিংবা যথাযথ ব্যবস্থা নেই ইত্যাদি। শহরের বহু স্কুলে napkin disposal machine থাকলেও সেটা কাজ করে না। নানা জায়গায় ভেন্ডিং মেশিনও আছে, যেগুলো কাজ করে না। গ্রামের স্কুলগুলোতে বা শহরেরও নানা জায়গায় যেখানে ন্যাপকিন, বা কাপ ইত্যাদি ব্যবহার কম, তাদেরকে উৎসাহ দেওয়া উচিৎ এবং অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করা উচিৎ। প্রকৃতির ক্ষতি হয় ন্যাপকিনে। কিন্তু এই স্যানিটারি প্রোডাক্টের যেরকম দাম ধার্য করা, তাতে কাপের ব্যবহার দুরস্থান, ন্যাপকিনই ব্যবহার করতে পারেন না কত মানুষ।
স্কুলগুলোতে এখনো নানা প্রকার ট্যাবু বজায় থাকলেও, একটু একটু করে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পুরনো কিছু গল্প শুনেছি, রক্তের দাগ দেখে টিটকিরি মারা, ইত্যাদির। এই কাজকর্ম আমি এখনো দেখিনি। তবে হ্যাঁ, শুনেছি, এখনো কিছু মেয়েরা মুখোমুখি হয়েছে, অনেকেই হয়ত। বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা একটু ফ্রী হয়েছে, ছেলেদের এবং মেয়েদের মধ্যে যৌনতা বিষয়ে আলোচনা যে সুস্থভাবেও হতে পারে, তাও দেখা গেছে, কারণ একে অপরের মানসিক বা শারীরিক অস্বস্তির কারণগুলো নিয়ে সংবেদনশীল হচ্ছে একটু একটু। এটা যদিও নিতান্তই আমার চোখে যেটুকু ধরা পড়েছে, আমার অত্যন্ত প্রিভিলেজড, কালচারালি এগিয়ে থাকা স্কুলে। আরও সবার যা মতামত, বা অন্য যা চিত্র ধরা পড়েছে, জানাবেন একটু।
আমি বেশ কিছু বন্ধুর সাথে কথা বললাম আমার, ভিন্ন ভিন্ন এলাকার। গ্রাম এলাকায় থাকা বন্ধুটির কথায় উঠে এল যে, তার কিছু বন্ধু, যারা বাড়িতে এসব শিক্ষা পেয়েছে, তারাই এই বিষয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। ছেলেদের এবং মেয়েদের মধ্যে এই আলোচনা হওয়ার মত সম্ভাবনা আসেনি কখনো, এবং এইসব আলোচনা সর্বসমক্ষে হওয়া নিয়ে একটা ইশ ছি ছি ব্যাপার আছে। তবে সে এটাও বলে যে মোটামুটি বাল্য বয়স থেকেই সবাই বদলগুলোর কথা জানত, ফলে অবাক হওয়া ইত্যাদি যে খুব দেখা গেছে এমন না। ছেলে মেয়েদের বেশী আলাপচারিতায় একটা অলিখিত বাধা আছে, ওর মতে খানিকটা গোঁড়া ওর ইস্কুল। এই গ্যাপটুকুর জন্য যদিও কোনোরকম টিটকিরি বা ঠাট্টার মুখে পড়তে হয়নি কাউকে, কিন্তু শিক্ষক শিক্ষিকাদের মুখে সেক্সিস্ট কমেন্ট বহুবার শোনা গেছে।
কলকাতাবাসী আরেক বন্ধু জানায়, তাদের স্কুলে গালাগালির ব্যবহার ভালই, যেখানে মাঝে মাঝেই উঠে আসে নানা সেক্সিস্ট কথা। আর শহর হলেও, পিরিয়ডস সংক্রান্ত কথাবার্তা খুব সাবলীলভাবে কেউ বলে না, যতক্ষণ না অন্যজন খুব কাছের হচ্ছে, তবে এটা স্বাভাবিকই। সে জানায় কিছু কুসংস্কারের কথা, যেগুলো আগেই উল্লেখ করেছিলাম আমি। ওর ভাষায়,
“No, biological processes like periods or menstruation have not been normalised since I personally face a lot of unnecessary restrictions from my family for instance I can't sit on others bed since I'm not pure, I'm not allowed to go to the temples while I'm menstruating , I can't cook foods whole I'm on my menstruation cycle , they hardly talk about this biological processes with the male members of the family. They often call it as 'Shorir kharap' (a bodily issue).”
ও জানায়, শরীরের নানা বদলগুলো নিয়ে ওকে নিজেকেই ইন্টারনেট থেকে জানতে হয়েছিল, কারণ বাড়িতে সেই আলোচনা করা পাপের সমান ছিল। এইটি অনেক বাড়িরই চিত্র। অনেক বাড়িতেই এই আলোচনা হয় ফিসফিস করে, ঠিক যেটুকু দরকার, সেইটুকুই। অনেক সময় ভাই বা দাদার থেকে লুকিয়েও রাখতে বলা হয়। এর বিপরীত চিত্রও যদিও দেখা যায় এখন, বেশ কিছু বাড়িতেই। নিজেরা যারা ঠিকঠাক শিক্ষা পাননি, তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত করার বিষয়ে খেয়াল রাখেন।
ও জানায়, ছেলেদের সাথে এই বিষয়ে কথা হয়নি, বলতে ভয় পেয়েছে, কারণ ও দেখেছে অনেক সময়েই অনেককে ইন্সেন্সিটিভ কমেন্ট করতে (এখানেই বোঝা গেল, আমার ধারণাটা শুধু আমার চারধার দেখেই, এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু ধরে নেওয়া সম্ভব না)।
নানা স্কুলেই, টিচারদের কথাবার্তার মধ্যে, বা স্কুলের নানা নিয়মনীতির মধ্যে সেক্সিজম আমরা বারবারই দেখেছি। সেক্স এডুকেশন জ্ঞান এবং চর্চা কম থাকারই প্রতিফলন সেটা। এরই মধ্যে একটা খবর পড়লাম, তামিলনাড়ুর একটি স্কুলে, একটি মেয়ের পিরিয়ডস চলছিল বলে তাকে ক্লাসে বসে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয় না, ক্লাসের বাইরে সিঁড়িতে বসে সে পরপর দুদিন পরীক্ষা দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার, সেই আদেশ যিনি তাকে দিয়েছেন, তিনিও একজন মহিলা, স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।
মানুষ ছোটবেলা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন করে, যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখানো হয় তাকে। কিন্তু সমস্ত রকম শিক্ষার মাঝেও ফাঁক থেকে যায় এই যৌনশিক্ষার। খোলাখুলি ভাবে কথা বলতে পারার শিক্ষা, যাতে যৌনতা শব্দটা আর নোংরা, অশ্লীল হয়ে থেকে না যায়, বরং বাল্য থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে যাওয়ার পথটাকে একটু সহজ এবং সুস্থ করে তোলে, একগাদা ফিসফাসের আড়ালে না থেকে।
Comments
Post a Comment