অর্ধজ্ঞান, কৌতূহল এবং যৌন শিক্ষা: একটি অপরিহার্য আলোচনার প্রেক্ষাপট
- আনন্দময়ী, XII
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন আমাদের স্কুল থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একটি পকেট ডিকশনারি দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি, কিন্তু কিশোর মানসিকতার অনিবার্য কৌতূহলে কিছু 'জ্ঞানী' সহপাঠী তার অন্য এক ব্যাখ্যা খুঁজে নেয়। তারা ‘sex’ শব্দটি খুঁজে বের করে, এবং ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে বাকিদের মধ্যে তার প্রচার করতে থাকে। আমরাও ছিলাম সেই অনুসারী দলেরই অংশ—এ যেন এক মহা-ঐন্দ্রজালিক, রহস্যঘেরা ও নিষিদ্ধ জ্ঞানের দ্বার উদ্ঘাটনের মুহূর্ত।
তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কোনো অনাবৃত দম্পতি যদি স্নানকক্ষে ওষ্ঠচুম্বনে লিপ্ত হয়, সেটিকেই বলে 'sex'। গর্ভধারণের ধারণা তখনো আমাদের কাছে ছিল দেবদূতীয় কল্পনা মাত্র। ডিকশনারির পাতায় ‘intercourse’ শব্দটি দেখে তারা যা অর্থ বের করেছিল, সেটি বুঝিয়ে বলা তখনকার কোনো 'অধ্যাপক'-এর পক্ষেই সম্ভব ছিল না। আর আমরা নিজেরাই বিচার করেছিলাম, এ দেশে সেক্সের মতো লজ্জাজনক অথচ সুখকর কিছুই নেই—তবে সেটি বিদেশে 'স্বাভাবিক' বলেই 'inter'-nation অর্থে এর উৎপত্তি হয়েছে!
শুধু আমাদের ক্লাসঘর নয়—এ ধরনের বিভ্রান্তিকর, অপূর্ণ ও রঙচঙে তথ্যেই বহু কিশোর-কিশোরী বেড়ে ওঠে। আর এর মূলে রয়েছে যৌনতা বিষয়ে সঠিক, প্রাঞ্জল ও বিজ্ঞাপনমুক্ত শিক্ষার অভাব। যৌবনের আগমুহূর্তে এ রকম উত্তেজনা স্বাভাবিক হলেও, তা যদি সুসংহত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রশমিত না হয়, তবে ভবিষ্যতে বিকৃত মনোভঙ্গির জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
যৌন শিক্ষা এই জায়গাতেই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল প্রজননতন্ত্র বোঝানোর বিষয় নয়, বরং বয়ঃসন্ধিকালে শরীরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সৃষ্টি হয়, তার সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানও এর উদ্দেশ্য। একইসঙ্গে এটি শেখায় সম্মতি, মর্যাদা, সম্পর্কের গঠন ও দায়িত্বশীলতা।
সমাজে এখনও স্বলৈঙ্গিক চেতনা কিংবা যৌনতা সম্পর্কে জানার ইচ্ছা অনেকের কাছেই অবৈধ বলে বিবেচিত হয়। ফলে বহু শিশুমন ছোটো থেকেই যৌনতা নিয়ে গুজব, অর্ধসত্য ও ভ্রান্ত ধারণা পুষে রাখে। সেখান থেকেই জন্ম নেয় সংকোচ, দ্বন্দ্ব ও কৃত্রিমতা। অথচ যৌনতা জীবনের স্বাভাবিক, বৈজ্ঞানিক ও মানবিক একটি অধ্যায়।
যৌনতা কোনো পরলৌকিক, রহস্যময় ব্যাপার নয়—বরং এটি জীবনের সবচেয়ে বড় লৌকিক সত্য। যৌনমিলন মানেই জীবনের ‘বিগ ব্যাং’—এক নতুন প্রাণের সূচনা। একে লুকিয়ে রাখার পরিবর্তে বিজ্ঞানভিত্তিক, নৈতিকতা-সমৃদ্ধ এবং মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক যৌন শিক্ষা চালু করাই সময়ের দাবি। যাতে প্রত্যেক কিশোর-কিশোরী নিজের শরীর ও মনকে ভালোবেসে চিনতে পারে, আর ভবিষ্যতে গড়ে উঠতে পারে একজন আত্মবিশ্বাসী, সম্মানবোধসম্পন্ন ও সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে।
Comments
Post a Comment