চুরমার হোক পিতৃতন্ত্র

একটি গণ আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। মহিলা-ট্রান্স-ক্যুয়ের মানুষের ডাকে ১৪ তারিখ ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ। মিছিলের মধ্যে স্লোগান উঠেছে বিচার চেয়ে, জবাব চেয়ে, ক্ষোভ ফুটেছে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তার সাথে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে পিতৃতন্ত্রের প্রতি ধিক্কার। কী এই পিতৃতন্ত্র? যার থেকে আজাদি চেয়ে স্লোগান দিয়েছে সব বয়েসের, সব লিঙ্গের মানুষ? এ এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে পৌরুষের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয় ‘শক্তি’, ‘ক্ষমতা’। সেই কারণেই পুরুষের থেকে আশা করা হয় ‘স্বভাবজাত’ ক্ষমতাধারীর অহঙ্কার, আর নারীকে শেখানো হয় অবদমিত হতে, অনুগত হতে, ভিরু গলায় আপোষ করে নিতে, কারণ কে জানে বাবা গলা তুললে কী না কী করে দেয়! পিতৃতন্ত্রের বীজ মানুষের মধ্যে পুঁতে দেয় এই সমাজই। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। যদিও, স্কুল, বাড়ির পরিবেশ এবং সংস্কৃতি একটি শিশুর মানসিকতার উপর ছাপ ফেলে। তার ফলে প্রতেকজনের সচেতনতা ভিন্ন পর্যায়ে থাকে।


একদম জন্মের সময় থেকেই যদি ধরি। বর্তমান প্রজন্মর মধ্যে হয়ত কিছুটা কমলেও, সাধারণত দেখা যায় ছেলে সন্তান জন্মানোর সঙ্গে পরিবারের অনেক বেশি সুখ এবং আকাঙ্খা জড়িত। সদ্যজাত শিশুর উপর আশা ভরসা রেখে ততক্ষণে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করে নেয় পিতা-মাতা। এখানে একটা কথা মনে করাই- নিজের পরিবার, নিজের চারপাশের পরিবার কিন্তু এই সমাজের পুরোটা না। অর্ধেকও না, তারও কম। কন্যা বা পুত্রের জন্মে পরিবার সমান খুশী হয়, এ কথা যে বলবে, তাকে ভুল প্রমাণ করতে, দুর্ভাগ্যবশত, খবরের কাগজে প্রায় প্রতিদিনই “শিশু কন্যাকে খুন পিতার/মাতার/দাদুর/দিদার”, “কন্যা ভ্রুণ হত্যা” হেডিঙে খবর বেরোয়। প্রত্যন্ত নানা গ্রামে এখনো শোনা যায় কন্যা শিশুর জন্ম দেওয়ায় খুন মাকেই। এত দূরেই বা যাই কেন। আমাদের বাঙালি সমাজেই প্রথা আছে ছেলে জন্ম দিলে মাকে বেশি সোনার গয়না উপহার দেওয়া, আর মেয়ে হলেই সোনার পরিমাণ হয়ে যায় অর্ধেক। কারণ, দিনের শেষে, “মেয়েরা তো বংশ রক্ষা করবে না।”


শৈশব, কৈশোর পার করছে সন্তান। বাড়িতে কোনও বাধানিষেধ নেই, এমনিই দেখা যাচ্ছে ছেলেটি খেলছে গাড়ি নিয়ে, আর মেয়েটি পুতুল। একদম ঠিক আছে, অবশ্যই যে যার একদম নিজস্ব ইচ্ছে মত খেলা ধূলা করবে। তবে ততক্ষণই এই ব্যাপারটি নিষ্পাপ যতক্ষণ না দেখা যাচ্ছে, ছেলেটা একদিন পুতুলে হাত দিয়েছিল বলে স্কুলের স্যার তাকে গিন্নি বলে ডেকেছে (রবীন্দ্রনাথের ‘গিন্নি’ গল্পটি), আর মেয়েটির পুতুল খেলা দেখে খুশি হয়ে পাশের বাড়ির মাসিমা বলেছে, “এ ভাল সংসার করবে”। মনে রাখা প্রয়োজন, লিঙ্গের সাথে এভাবে নির্দিষ্ট খেলা, নির্দিষ্ট রং, নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব (কঠোর, নরম, ইত্যাদি) বেঁধে দেওয়া মানে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কিন্তু এই বেঁধে দেওয়া রয়ে গেছে বলেই পিতৃতন্ত্রের বিষ ছড়িয়ে আছে আজও। সমাজকে ভয় সব্বাই পায়। হ্যাঁ, শহুরে জীবনে ‘একঘরে’ করে দেওয়ার কন্সেপ্ট নেইই প্রায়। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের গড়ে দেওয়া অলিখিত নিয়মগুলো এমন কঠোর ভাবেই মানুষের মনে ঢুকে গেছে, যে শিশুদের নিষ্কলুষ মনও তার থেকে রেহাই পায় না। তাই ক্লাস ফাইভ সিক্সেই, কোনও ছেলের মধ্যে সমাজের আশামত কাঠিন্যের অভাব দেখলে তার বন্ধুদের দ্বারাই “হিজড়ে”, “সমকামী (গে)” ইত্যাদি নানা ডাকে তিতিবিরক্ত করে দেওয়া হয়। এগুলোকে ছোটবেলা থেকেই বাজে কিছু ভাবার একটা ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে তাই সবাই। তাই বড়ো হয়ে যদি সত্যি নিজের orientation বা gender নিয়ে কেউ চিন্তিত হয়, সেটাকে সমাজে প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে অনেকসময়।


যৌবনে পা দেওয়ার সাথে সাথে মুখে ফুটছে নানা রকম বাজে ভাষা। বর্তমান সমাজে অনেকাংশের মধ্যেই বীভৎস গালাগালি শোনা যায়। অধিকাংশই প্রচণ্ড হিংস্র। ক্ষমতাধারীর ক্ষমতাহীনের উপর অত্যাচারটাই প্রধানত তার বিষয় হয় (ভেবে দেখুন সবাই)। অনেককেই দেখি, মানে না বুঝেই সমস্ত গালাগালি দেয়। রেগে গেলে নিজেকে সামলাতে শেখা প্রয়োজন, এবং রেগে গেলে কী বলছি তাও জানা প্রয়োজন। মানুষের নানা অঙ্গকে নিয়ে মন্তব্য করা থেকে শুরু করে কারোর উপর রেগে গেলে তার পরিবারের শিশু বা মেয়েদের উপর অত্যাচার করার হুমকি, দুর্ভাগ্যবশত বাস্তব কাহিনীও প্রচুর শোনা যায়। খবরের কাগজ খুললেই শিহরিত হতে হতে, একসময়ে এগুলো সাধারণ ব্যাপার হয়ে যেতে শুরু করেছে। মনে করাব, কোনোরকম হিংস্রতা কখনো যেন “নর্মাল” না হয়ে যায়। অনেকসময়েই দেখেছি, কোনও মেয়েকে বর্ণনা করতে চূড়ান্ত মতামত দেওয়া হয়েছে। যাকে “স্লাট শেমিং” বলে। মনে রাখা ভাল, এক বছরে তিনজনের সাথে প্রেম করলে, অনেকগুলো ছেলে বন্ধু থাকলে, হাঁটুর উপর স্কার্ট পরলে, এবং আপনার বন্ধুকে বা আপনার প্রেমের আবেদনকে রিজেক্ট করে দিলেই সে স্লাট হয়ে যায় না। এবং অতি অবশ্যই, সেটাও একটা গালাগালি হিসেবে কতটা যোগ্য সেটা ভেবে দেখবেন। সমস্ত পেশার সমান অধিকার ইত্যাদি বক্তব্য রেখে, তারপরও যারা গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করেন যৌনকর্মীদেরদের কথা, তাঁরা মনে রাখবেন- অধিকাংশ সময়ে হয় পাচার হয়ে গিয়ে, বা আর্থিক চাপে, নিজের দেহকে পণ্য বানাতে বাধ্য হওয়া মেয়েরা কিন্তু এই পিতৃতন্ত্রেরই শিকার। এখন সবাই ভাবতে বুঝছে, ভাবতে পথে নামছে।


যৌবনেরই দোষ হয়ত, কিন্তু আশা করতে ভাল লাগে, একসময়ে এই ব্যবস্থা হারিয়ে যাবে সমাজের বুক থেকে। সাম্যবাদে ভরসা রাখবে মানুষ। সেই আশা থেকেই যখন দেখি- নিতান্তই অভ্যেস হয়ে যাওয়া ছোট ছোট গালাগালি, ইয়ার্কি, ইত্যাদি শুনে ভ্রু কুঁচকালে মানে বোঝার চেষ্টা করছে বক্তা, বুঝতে পারলে ভুল স্বীকার করছে- তখন এই দুঃখের সময়েও শান্তিতে ভরে ওঠে মন। শান্তির খোঁজে দৌড়ায় সব মানুষ। দেখেছি আমরা বারবার, শান্তির জন্য লড়াই করতে মানুষ সর্বদা প্রস্তুত। শরীরকে objectify করা মানুষরা, পিতৃতন্ত্র থেকে সুবিধা পাওয়া মানুষরা, নিতান্তই জন্ম থেকে পিতৃতন্ত্রের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়া মানুষরা, মেয়েদের প্রত্যেকটা অস্বস্তিকে ন্যাকামি বলে দাগিয়ে দেওয়া মানুষরা, পিতৃতান্ত্রিক রক্ষণশীলতা বহন করেন যে নারীরা, নারীমুক্তির মিছিলে গিয়ে মাইক ছিনিয়ে নেন যে পুরুষরা, সবাই তাই প্রত্যেকটা মন্তব্যের আগে, প্রত্যেকটা কাজের আগে এখন অযুতবার ভাববেন। পিতৃতন্ত্রের ঢাক পিটিয়ে বেড়াবার আগে আরও কয়েক কোটি বার ভাববেন। সহস্র বছর ধরে সমাজের বহু মানুষ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে কড়া প্রাচীর গড়ে দাঁড়িয়ে ছিলই, তারা দিনে দিনে শুধু সংখ্যায় বাড়ছে। আজকে রাত পেরোক, কালকে দিন পোহাক, পরশু দেখবেন তারাই- আমরাই সবাই।


-রূপকথা, একাদশ শ্রেণী

Comments